রাজবাড়ী শিশু হাসপাতাল এখন ভূতের বাড়ি
১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৬
।। মো. আশিকুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
রাজবাড়ী : আর্থিক ও চিকিৎসক সংকটের কারণে ২২ বছর ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে অবশেষে বন্ধ হয়ে গেছে রাজবাড়ী পৌর শিশু হাসপাতালটি। প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ হওয়া একতলা ভবনের চার কক্ষ বিশিষ্ট হাসপাতালটি বর্তমানে জরাজীর্ণ ভূতের বাড়িতে রুপ নিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, আর্থিক সংকটের কারণে এই মুহূর্তে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না হাসপাতালটি।
এদিকে জেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতালের অভাবে নবজাতকসহ শিশুদের চিকিৎসা করাতে খুবই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে অভিভাবকদের। বিশেষ করে জটিল রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে গত এক মাসে রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল থেকে ৩৫ শিশুকে ফরিদপুরসহ বিভিন্ন শিশু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
রাজবাড়ী পৌরসভা সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালের দিকে রাজবাড়ী পৌরসভার উদ্যোগে শহরের নতুনবাজার এলাকায় পৌর শিশু হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর সেখানে একজন চিকিৎসক রোগী দেখে শুধু ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এভাবেই চলেছে ২২ বছর। সর্বশেষ ওই হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন পৌরসভার মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবদুর রশিদ। ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেওয়ার পর হাসপাতালটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
ডা. আবদুর রশিদ সারাবাংলাকে জানান, তিনি ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে রাজবাড়ী পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। পৌরসভার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পৌর শিশু হাসপাতালে প্রতিদিন (ছুটির দিন বাদে) দুই ঘণ্টা করে রোগী দেখতেন। রোগী দেখে শুধু ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কার্যক্রম। তা সত্ত্বেও প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগী হতো।
এই হাসপাতালটি পৌরসভার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র শিশু হাসপাতাল বলে জানান ডা. আব্দুর রশিদ।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চার কক্ষবিশিষ্ট শিশু হাসপাতালটির জরাজীর্ণ একটি কক্ষেই পরিচালিত হচ্ছে সূর্যের হাসি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম। বাকি তিনটি কক্ষের দু’টির দরজা খোলা এবং একটির দরজা ভাঙা রয়েছে। জরাজীর্ণ কক্ষগুলোর সবগুলো জানালা খোলা থাকায় ভেতরে ধূলা-ময়লার স্তুপ জমে গেছে।
কথা হয় সূর্যের হাসি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের সার্ভিস প্রমোটর শায়লা খানের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সপ্তাহে দু’দিন (সোম ও মঙ্গলবার) আমরা এখানে আমাদের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করি।
এদিকে, পাঁচটি উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজবাড়ী জেলার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ লাখের বেশি। এতো জনসংখ্যার চিকিৎসাসেবার একমাত্র ভরসাস্থল ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল। এছাড়া রাজবাড়ীতে পূর্ণাঙ্গ একটি শিশু হাসপাতাল না থাকায় প্রতিনিয়তই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে জন্মের পরপর নবজাতক যখন নিঃশ্বাস নিতে পারে না তখন জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। এসব ক্ষেত্রে অবস্থাপন্ন মানুষরা হয়তো তাৎক্ষণিক ভালো কোনো হাসপাতালে যেতে পারে। কিন্তু দরিদ্র রোগীরা পড়ে মহাবিপাকে।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, সদর হাসপাতালে শিশুদের জন্য একজন চিকিৎসক রয়েছেন। আর শয্যা রয়েছে ১৫ টি। এখানে মাসে গড়ে তিনশ’ শিশু ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এসব শিশু বেশিরভাগই জ্বর, খিঁচুনি, ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত থাকে। প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসার সরঞ্জাম না থাকায় গত ডিসেম্বর মাসে ৩৫ জন শিশু রোগীকে রেফার্ড করা হয়েছে পাশ্ববর্তী ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে।
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আলী আহসান তুহিন সারাবাংলাকে বলেন, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে শিশুদের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল ও চিকিৎসার সরঞ্জাম নেই। যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত শিশুদের রেফার্ড করতে হয়। অনেক সময় জন্মের পর শিশুরা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট পায়। এসব ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে শিশুদের কৃত্তিম শ্বাসপ্রশ্বাস (ভেন্টিলেশন) চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখানে সেই ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া বেশি দিনের জ্বর, ভেরিসোভিয়া নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদেরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যথেষ্ট উপাদান নেই হাসপাতালে। তাই যখন আমাদের হাতে কোনো উপায় থাকে না তখন রেফার্ড করতে বাধ্য হই।
পৌর শিশু হাসপাতাল বন্ধের বিষয়ে রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, পৌরসভার মেডিক্যাল অফিসার ডা. আবদুর রশিদ স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার কারণে পৌর শিশু হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ আছে। এছাড়া পৌরসভার আর্থিক সংকটের কারণে আপাতত বন্ধ রাখতে হয়েছে। আর্থিক সংকট দূর হলে এবং নতুন একজন ডাক্তার নিয়োগ হলে আবার শিশু হাসপাতালটি চালু হবে।
সারাবাংলা/এনএইচ