এমপির দুঃখপ্রকাশ, পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার
১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:৫১
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েই পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের দুই নেতাকে ‘পিটিয়ে’ বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। মাত্র পাঁচ বছর আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া দিদারুল আলমের এই কর্মকাণ্ডের পর বৃহত্তর চট্টগ্রামে ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল পরিবহন শ্রমিকদের একটি সংগঠন। তবে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে সংসদ সদস্য নিজে এসে ঘটনার জন্য ‘দুঃখপ্রকাশ করায়’ আহ্বানের দুই ঘণ্টা পর সেই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিকরা।
পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ, নির্বাচনি এলাকায় চলাচলরত গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সরকার দলীয় এই সংসদ সদস্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের ওপর চড়াও হয়েছিলেন। এসময় তিনি নির্বাচিত সাংসদকে অভিনন্দন জানিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের দেওয়া ফুলও ছিঁড়ে ফেলেন।
তবে সংসদ সদস্য দিদারুল আলম মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তিনি পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও অভিযোগ এনেছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশের পর থেকে তার মোবাইল সচল পাওয় যায়নি।
রোববার (১৩ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে সোমবার ভোর ৬টা থেকে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের ডাক দেয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখা।
সংবাদ সম্মেলনে ফেডারেশনের আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মুছা বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে সাংসদ নিজে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অলি আহামদ ও সীতাকুণ্ডের ৮ নম্বর রুটে চলাচলকারী হিউম্যান হ্যলার মালিক সমিতির নেতাদের ডেকে নগরীর কাট্টলীতে তার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে আলাপের একপর্যায়ে সাংসদ মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলম ও অলি আহামদকে ৮ নম্বর রুটের গাড়ি পরিচালনা ও সমিতির নিয়ন্ত্রণ তার বরাবরে লিখিতভাবে ছেড়ে দিতে বলেন। না হলে প্রতিমাসে তাকে দুই লাখ টাকা করে দিতে হবে বলে জানান।
‘শ্রমিকদের মতামত ছাড়া সেটা ছাড়া যাবে না বলে তাকে (সাংসদ) জানালে তিনি রেগে যান। প্রথমে গালিগালাজ শুরু করেন। এরপর নিজে সমিতির যুগ্ম সম্পাদক খোরশেদ আলমকে বেধড়ক মারধর করেন। এসময় সাংসদের বাসায় থাকা কয়েকজন যুবকও তাকে মারধর করেন। অলি আহামদ পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেও সংসদ সদস্য আরও রেগে যান। লোকজন অলি আহামদকেও মারধর করে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন,’— বলেন মুছা।
অলি আহামদ বলেন, ‘আমরা ওইদিন রাতে তাকে ফুল দিতে গিয়েছিলাম। উনি তা ছিঁড়ে ফেলে বাজেভাবে কথা বলেন এবং মালিক সমিতির খোরশেদ আলমকে মারধর শুরু করেন। তাকে নিবৃত্ত করতে গেলে আমাকে মারধর করে তার লোকদেরও মারার জন্য বলেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আনা অভিযোগের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জানতে চাইলে মারধরের অভিযোগ নাকচ করে সংসদ সদস্য দিদারুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমি মারধর করব, এটা কি বিশ্বাস হয়?’
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম শহর থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত যেসব হিউম্যান হলার চলাচল করে সেগুলোর মালিক-শ্রমিকদের কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি হয়ে আছে। যাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এই সমস্যা সমাধানে তাদের ডাকা হয়েছিল। আমি চাপ দেওয়ায় এখন মারধর করেছি বলে ইস্যু বানিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে।
এদিকে, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পর পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে সংসদ সদস্য দিদারপন্থী ‘বৃহত্তর চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন।
তবে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সংবাদ সম্মেলনের পরই তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেনের কার্যালয়ে। সেখানে সংসদ সদস্য দিদারুল আলম, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা, দু’জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন।
দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জেলা প্রশাসক চট্টগ্রাম মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনের মধ্যস্থতায় চট্টগ্রামে শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন শ্রমিক নেতারা।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ মুছা সারাবাংলাকে বলেন, এমপি সাহেব নিজে বৈঠকে ছিলেন। তিনি ঘটনার জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছেন। এছাড়া আমাদের নেতা অলি আহামদকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, তার ভুল হয়ে গেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সম্মানজনক মীমাংসার কথা বলা হয়েছে। আমরা গাড়ি চালাই। ধর্মঘট করা আমাদের নেশা বা পেশা না। হুট করে একটা ঘটনা হয়েছিল, শ্রমিক ভাইদের চাপে আমরা কর্মসূচি দিয়েছিলাম। এখন সংসদ সদস্য যেহেতু নিজে ভুল স্বীকার করেছেন, প্রশাসনও সম্মানজনক মীমাংসা চেয়েছেন, আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছি।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও সংসদ সদস্য দিদারুল আলমের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের ব্যবসা অঙ্গনের পরিচিত মুখ দিদারুল আলম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও মহানগরীর একাংশ) আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাদশ সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং আবারও সংসদ সদস্য হয়েছেন।
দিদারুল আলমের চাচা এম মনজুর আলম আওয়ামী লীগের সমর্থনে একাধিকবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হন। ২০১৫ সালে আবারও বিএনপি থেকে মেয়র প্রার্থী হয়ে ভোটে হেরে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেন। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আবারও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং ও হালিশহর) আসন থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর