রিজার্ভ চুরি: ৩ বছরে মামলার অগ্রগতি কতদূর?
১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:৩১
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: তিন বছর পার হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি দেশে। ঘটনা অনুসন্ধানে সিআইডি এখনও তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তবে চুরির ঘটনায় মামলা করতে আর্থিক বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল এখন যুক্তরাষ্ট্রে। মামলার প্রস্তুতি নিতে সেখানকার আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক দুই গভর্নর বলছেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলে অবশ্যই টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।
আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। ২০১৬ সালের এই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই অর্থ চুরি করা হয়। চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলংকায় ২ কোটি ডলার এবং বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রথমে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) একটি শাখায় পাঠানো হয়। পরে এই অর্থ আরসিবিসি থেকে চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে।
আরও পড়ুন- রিজার্ভ চুরি: ফিলিপাইনের ব্যাংক কর্মকর্তা দেগুইতোর কারাদণ্ড
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকারের তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে জমা দিয়েছি। এটা প্রকাশ করা বা না করার এখতিয়ার সরকারের।
তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে, কূটনৈতিকভাবে এবং আইনিভাবে সরকার পদক্ষেপ নিলে এটা উদ্ধার সহজ হতো। কিন্তু অনেক বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।’
প্রতিবেদনে ফিলিপাইনের আরসিবিসিকে দায়ী করা হয়েছিল জানিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘কেবল দায়ী করা নয়, প্রতিবেদনে আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশও করা হয়েছে। অথচ কেউ কেউ নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলেছেন। এটা ভুল। বরং তাদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক আদালতে আরসিবিসি’র বিরুদ্ধে মামলা করলে আমরা জিতব এবং চুরির পুরো টাকা ফেরত পাওয়া সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, রিজার্ভ চুরির বিষয়ে আরসিবিসি যে জড়িত, তা ফিলিপাইন সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলে অবশ্যই আমরা জিতব এবং টাকা ফেরত পাব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কারণ অনুসন্ধানে সিআইডি তদন্ত করছে। তদন্ত প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলে প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন- বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার প্রতিবেদন ১০ ফেব্রুয়ারি
তিন বছরেও প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ার কারণ এবং প্রতিবেদন দ্রুত প্রকাশের জন্য সিআইডিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো তাগাদা দিচ্ছে কি না— জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে তাগাদা দেওয়ার কিছু নেই। কারণ অর্থমন্ত্রণালয়, তথা রাষ্ট্র স্বয়ং বিষয়টি দেখভাল করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই মুখপাত্র আরও বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করতে আর্থিক বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তারা সেখানে মামলা করার বিষয় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর এজন্য সেখানে আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
প্রথম বছর ফেরত আসে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার
২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়ার ১০ মাসের মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত আনা হয়। এর মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার আগেই ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শ্রীলংকা থেকে ২ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়। একই বছরের ১২ নভেম্বর ফিলিপাইন থেকে ফেরত আসে আরও ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। পরবর্তী দুই বছরের বেশি সময়ে আর কোনো টাকা উদ্ধার করা যায়নি। ফলে ফিলিপাইনে থাকা অবশিষ্ট ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার (৫৫৭ কোটি টাকা) এখনও ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। কবে আনা যাবে কিংবা আদৌ আনা যাবে কিনা, তা নিয়েও নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।
আরও পড়ুন- রিজার্ভ চুরি: ২৮ বারের মত প্রতিবেদন দাখিলের সময় পেছালো
বানান ভুলের কারণে ১৯৪ কোটি ডলার নিতে পারেনি হ্যাকাররা
রিজার্ভ চুরির ঘটনার বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ হতে শুরু করলে জানা যায়, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১৯৪ কোটি ডলার চুরি করার চেষ্টা করলেও বানান ভুলের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তখন জানা যায়, রিজার্ভ চুরির ঘটনা একমাসেরও বেশি সময় গোপন রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ গণমাধ্যমে রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা স্বীকার করে নেয়। পরে এই ঘটনায় ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। পরে পদত্যাগ করে দুই ডেপুটি গর্ভনরও।
পদত্যাগ ছাড়া কোনো শাস্তি হয়নি
রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় তৎকালীন গর্ভনরের পদত্যাগ আর দুই ডেপুটি গভর্নরকে অব্যাহতি দেওয়া ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের আর কোনো কর্মকর্তার কোনো শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই ঘটনা কেন ঘটল, কারও কোনো দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে কিনা কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিল কিনা— এসব বিষয় আমলে নিয়ে কাউকে শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। আর এজন্য বিশিষ্টজনেরা দায়ী করছেন রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গঠিত দুই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশ না হওয়াকেই। একইসঙ্গে তারা অবিলম্বে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান।
তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা দায়ের
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনকে প্রধান করে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত শেষে একই বছরের ৩০ মে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এরই মধ্যে আড়াই বছরের বেশি সময় পার হলেও সরকার তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে, একই দিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় একটি মামলায় দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা এই মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এরই মধ্যে ৩৫ মাস অতিবাহিত হলেও সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। উল্টো প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালত থেকে বারবার সময় নিচ্ছে সিআইডি। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সিইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলাটি তদন্ত তদারকি করছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম।
রিজার্ভ চুরির তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, কোনো ঘটনার তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। বাংলাদেশ সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় মামলা করতে আইনি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। প্রতিনিধি দলের বাকি তিন সদস্য হলেন— বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়ালি ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর আবু হেনা মো. রাজী হাসানসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও দু’জন কর্মকর্তা।
তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার আগেই মামলা করার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশে কারও শাস্তি না হলেও ফিলিপাইনে হয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দেশে তদন্তের তেমন অগ্রগতি না থাকলেও ফিলিপাইন সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে আরসিবিসিকে ফিলিপাইনের সিনেট ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেছে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আরসিবিসি’র সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে দোষী সাবাস্ত করে ৫৬ বছরের কারাদণ্ডসহ জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে, আরসিবিসি প্রধান নির্বাহী অপরাধ স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের করণীয় হলো— আমাদের প্রশাসনিক ও সিআইডি‘র তদন্ত প্রতিবেদন দু’টি দ্রুত প্রকাশ করে প্রতিবেদনের আলোকে দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
তিনি বলেন, সরকারকে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে চুরি হওয়া টাকাটা যেন জরিমানাসহ আদায় করা যায়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে। কারণ ফিলিপাইনের রিজার্ভ ব্যাংকের জন্য ৫/৬শ কোটি টাকা তেমন কিছু না।
তিনি বলেন, রিজার্ভ চুরির জন্য দায়ী ফিলিপাইনের আরসিবিসি। তাই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। সেই মামলা পরিচালনার জন্য দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ আইনজীবীও নিয়োগ দিতে হবে।
সারাবাংলা/জিএস/জেএএম