নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ, বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি টিআইবি’র
১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৩৩
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। তাই, এই নির্বাচন নিয়ে বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত।’ মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনের অনিয়ম দূর করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ভুমিকা ছিল অতি নগণ্য। তারা সব দলের জন্য সমান পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। এমনকি ইসি প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধী প্রার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীনদের বল প্রয়োগ করতেও দেখা গেছে।’
টিআইবি’র তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কমিশনের নির্দেশনার বাইরে অতিরিক্ত খরচ, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভুমিকা, জাল ভোট দেওয়া, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সীল মেরে রাখা, বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সীল মেরে জাল ভোট প্রদান, পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো, ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভরে রাখা ও প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীর নেতা কর্মীদের মারধর করা।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৫টি জেলার ৫০টি আসন থেকে সংগ্রহ করা তথ্য নিয়ে গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে এসব তথ্য তুলে ধরে টিআইবি।
নির্বাচন প্রসঙ্গে, টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন বলতে যা বোঝায় সেটা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়নি। ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আমরা প্রশ্ন পর্যন্তই তুলতে পারি। আর কিছু করতে পারি না। এজন্যই আমরা বলেছি, নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে তা বিচারবিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক। সুপারিশ করেছি নির্বাচনে যেসব ত্রুটি ছিল তা সংশোধন করে আগামী নির্বাচনগুলোতে যাতে সমাধান করা যায়।
নির্বাচনে প্রচার প্রচারণার ক্ষেত্রে টিআইবি তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গবেষণায় অন্ত্ভূক্ত সবগুলো আসনে প্রচারণার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকে এককভাবে সক্রিয় দেখা গেছে। কোনো কোনো আসনে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায়, প্রশাসন-আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মচারী কর্তৃক প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ, সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণা করা হয়েছে। অন্যদিকে গবেষণায় অন্তভূক্ত ৪৪টি আসনে (৬টির তথ্য পাওয়া যায়নি) সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ, প্রশাসন কর্তৃক হুমকি, হয়রানি, প্রার্থী, নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত ছিল। এসব আসনে ১২ হাজার ৬৮৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যাদের মধ্যে ৩ হাজার ৭৩৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে ভয়ভীতি দেখানো, গ্রেফতার হওয়া ও মামলা থাকার কারণে বিরোধী দলের প্রার্থী ও নেতা কর্মীরা প্রচারণা চালাতে ব্যর্থ হন।
গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ৫০টির মধ্যে ১৯টি আসনে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিপক্ষ দলের প্রার্থীদের নেতা কর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনি ক্যাম্প ভাংচুর করা, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ৫০টির মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাঁধা দেওয়ার ঘটনা উঠে আসে টিআইবির গবেষণায়।
গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত সবগুলো আসনেই প্রার্থীদের কোনো না কোনো আচরণ বিধি লঙ্ঘন হয়েছে বলে জানায় টিআইবি। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড প্রতি একাধিক ক্যাম্প স্থাপন, মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন, নির্ধারিত সময়ের বাইরে প্রচারণা চালানো, দেওয়ালে ও যানবাহনে পোস্টার ও লিফলেট লাগানো, পোস্টারে মুদ্রণ সংখ্যা, প্রেসের নাম দেওয়া, ফোন নম্বর না দেওয়া, আলোকসজ্জা, প্রার্থীর ছবি ও প্রতীকসহ টি শার্ট-ক্যাপ পরিধান, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীর প্রচারণায় প্রকাশ্যে বাধা দেওয়া, জনসভা করতে না দেওয়া, পোস্টার টাঙাতে না দেওয়া বা ছিড়ে ফেলা, মাইকিং করতে না দেওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। গবেষণায় অন্তর্ভূক্ত চারটি আসনে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়ে প্রতিকার পাওয়া গেলেও বাকী আসনগুলোতে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও সংবাদ মাধ্যমের জন্য বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞার কারণে কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর। নির্বাচনের সময়ে ইন্টারনেটের গতি হ্রাস করা হয়, মোবাইল ফোনের জন্য ফোর জি ও থ্রি জি নেটওয়ার্ক বন্ধ রাখা হয়। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোটরচালিত যানবাহন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নির্বাচনের সময়ে এ ধরণের তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ক্ষমতায় থাকার কারণে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ ও ‘আমরা বাংলাদেশের পক্ষে’ নামক টিভিসি প্রচার করা হয়। যার প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) বিরোধী দলগুলোর প্রচারণা ছিল অনুপস্থিত।
টিআইবি সার্বিকভাবে এক কথায় বলেছে, সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ বলা গেলেও তা ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আংশিক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়েছে যেটা আমরা বলছি। কারণ সব দল অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য যা বোঝায়, তা হয়নি। যেমন, নির্বিঘ্নে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি ও ভোট দিতে দেওয়া হয়নি, প্রচার প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে।
গণতন্ত্রের জন্য এরকম নির্বাচন কি ধরণের ভূমিকা পালন করতে পারে জানতে চাইলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবশ্যই গণতন্ত্রের জন্য এরকম একটি নির্বাচন ইতিবাচক নয়। এজন্য বলা হচ্ছে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য কিনা সে বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। তবে এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। আর কারা সিল মেরেছে সেটাও আমরা বলতে পারব না।
সারাবাংলা/ইউজে/জেএএম