ব্রেক্সিট খসড়া বাতিল: কী করবেন থেরেসা মে?
১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:০১
।। আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।
শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সংসদে হেরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ব্রেক্সিট সংক্রান্ত যে খসড় চুক্তি তিনি উত্থাপন করেছিলেন, তা নাকচ হয়ে গেছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে। ২০২ জন সংসদ সদস্য এই চুক্তির পক্ষে ভোট দিলেও এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন ৪৩২ জন। মে’র নিজ দলেরেই শতাধিক সংসদ সদস্য এই প্রস্তাবের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন সংসদে। এরই মধ্যে থেরেসা মে’র বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাবও তুলেছেন বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবিন। এ পরিস্থিতিতে কী করবেন থেরেসা মে? তিনি কি পারবেন ব্রেক্সিটের জন্য নতুন কোনো খসড়া উত্থাপন করে তা পাস করাতে? নাকি তাকে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ফের গণভোটের আয়োজন করতে হবে? নাকি শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করে নতুন সাধারণ নির্বাচনেরই ঘোষণা দিতে হবে থেরেসা মে’কে? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে যুক্তরাজ্যে। আর এসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটেনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ।
আরও পড়ুন- ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নাকচ হলো থেরেসার ব্রেক্সিট খসড়া চুক্তি
২০১১ সালের ফ্রিক্সড টার্ম পার্লামেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর ব্রিটেনে সাধারণ অনুষ্ঠিত হবে। সেই অনুযায়ী ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হলে সংসদ সদস্যদের এখনই নির্ধারণ করতে হবে থেরেসা মে তার মেয়াদ চালিয়ে যাবেন নাকি নতুন কোনো প্রধানমন্ত্রী খুঁজতে হবে ব্রিটেনকে। আর এই অনাস্থা ভোটে মে হেরে গেলে সেক্ষেত্রে ১৪ দিনের কাউন্টডাউন শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে বর্তমান সরকার বা অন্য কোনো বিকল্প সরকার যদি নতুন করে আস্থা ভোটে বিজয়ী না হতে পারে, তবে সাধারণ নির্বাচনই ভবিতব্য। তবে তার জন্য অন্তত ২৫ কর্মদিবস অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে, অনাস্থা ভোটের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে গেলে সেক্ষেত্রে বিকল্প বেশকিছু পথ খোলা থাকবে থেরেসা মে’র সামনে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে নতুন করে গণভোট যেমন আয়োজন করতে পারবেন তিনি, তেমনি নতুন করে ব্রেক্সিটের খসড়া চুক্তি উত্থাপন করে সংসদের সমর্থন পাওয়ার সুযোগও থাকবে। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য যেসব পদক্ষেপ মে সরকার নিতে পারে, সেগুলোই সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
ব্রেক্সিট চুক্তি বাতিল
যদি নতুন করে কিছুই না ঘটে, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ‘নো-ডিল ব্রেক্সিট’ বা কোনো চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর হবে। অর্থাৎ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনকে বের হয়ে যেতে হবে কোনো শর্ত ছাড়াই। এ বিষয়ক যে আইন বিদ্যমান রয়েছে, সে অনুযায়ী চলতি বছরের ২৯ মার্চ ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবে ব্রিটেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো কিছু আইন প্রণয়নের চেষ্টা হতে পারে। তবে তারও খুব বেশি প্রয়োজনীয়তা নেই।
এদিকে, গত ৮ জানুয়ারি নো-ডিল ব্রেক্সিট ইস্যুতে সরকারকে পরাজিত করেছিলেন সংসদ সদস্যরা। সুনির্দিষ্ট খাতে কর আহরণের ক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগের ক্ষমতা সীমিত রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন তারা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমপিদের এই ভোট ছিল প্রতীকি। ওই ভোটের ফল হিসেবে সরকার বিকল্প পদ্ধতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করলে ব্রিটিশ সংসদ সম্ভবত নো-ডিল ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের বিপক্ষেই অবস্থান নেবেন।
ব্রেক্সিটের জন্য নতুন চুক্তি
থেরেসা মে সরকারের সামনে দ্বিতীয় পথ হলো ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে নতুন চুক্তির খসড়া উত্থাপন করা। এ ক্ষেত্রে বর্তমান খসড়ায় ব্যাপক রদবদল আনতে হবে সরকারকে। বলা যেতে পারে, ব্রেক্সিটের এই চুক্তির খসড়াকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্রেক্সিটের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য আর্টিকেল ৫০-এ নির্ধারিত সময়ও বাড়িয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
আরও পড়ুন- থেরেসা মে’র সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট চেয়েছে বিরোধী দল
থেরেসা মে সরকার এই পথে হাঁটলে প্রথমত ইইউয়ের কাছে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের সময় বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে ব্রিটেনকে। ইইউ কাউন্সিলে ইইউয়ের সকল সদস্য দেশ এই আবেদনের পক্ষে ভোট দিলেই কেবল বাড়তি সময় পেতে পারে ব্রিটেন। ইইউ থেকে বাড়তি এই সময় পেলে ব্রিটেনের নিজেদের ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন বিষয়ক আইনে ‘এক্সিট ডে’ বা ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দিনের সংজ্ঞাও পাল্টাতে হবে। সেটিও করতে হবে সংসদ সদস্যদের ভোটে।
এদিকে, ইইউ যদি ব্রিটেনকে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে বাড়তি এই সময় না দেয়, তাহলে বিকল্প কোনো পথে যেতে হবে মে সরকারকে।
ব্রেক্সিট নিয়ে ফের গণভোট
ব্রেক্সিট নিয়ে ফের একটি গণভোটের আয়োজনও করতে পারেন থেরেসা মে। তবে সেক্ষেত্রেও আর্টিকেল ৫০-এ উল্লেখিত সময় বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। কেননা, ওই বিধি অনুযায়ী ২৯ মার্চের মধ্যেই ব্রেক্সিট কার্যকর করতে হবে এবং ২৯ মার্চের আগে কার্যত গণভোট আয়োজন সম্ভব নয়।
গণভোটের আয়োজন স্বয়ংক্রিয়ভাবেও হবে না। পলিটিক্যাল পার্টিজ, ইলেকশনস অ্যান্ড রেফারেন্ডামস অ্যাক্ট ২০০০ অনুযায়ী, গণভোট আয়োজন করতে হলে নতুন বিধি তৈরি করতে হবে এবং এই গণভোটের নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। এই গণভোটে কারা ভোট দিতে পারবেন, গণভোটের উদ্দেশ্য কী— এমন সব বিষয়গুলো নির্ধারণ করতে হবে সরকারকে। এটাও তাড়াহুড়ো করে আয়োজনের সুযোগ নেই। কারণ গণভোট আয়োজনের জন্য ইলেকটোরাল কমিশনকেও গণভোটের উপযোগিতা বিবেচনা ও এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার সময় দিতে হবে। তারা নির্ধারণ করবেন, কোন প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয় বিধি তৈরি করে পাস করা গেলেও সঙ্গে সঙ্গেই গণভোট আয়োজন করতে পারবে না মে সরকার। কারণ গণভোটের আগে আবার কিছু সময় দিতে হবে, যাকে বলা হয় ‘রেফারেন্ডাম পিরিয়ড’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধাপ পেরিয়ে একটি নতুন গণভোট আয়োজন করতে প্রায় ২২ সপ্তাহ মতো সময় লেগে যাবে। অনেক খাটুনি করে এই সময় খানিকটা কমানো গেলেও ২৯ মার্চের আগে কোনোভাবেই গণভোট আয়োজন সম্ভব না।
সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা
ব্রেক্সিট নিয়ে রাজনৈতিক ম্যান্ডেট হাসিল করতে চাইলে থেরেসা মে’র সামনে সম্ভবত সবচেয়ে ভালো পথ হলো সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করা। ব্রেক্সিট নিয়ে তিনি যেভাবে আটকে পড়েছেন, তাতে সাধারণ নির্বাচন তার জন্য অনেক পথ উন্মুক্ত করে দেবে। সেক্ষেত্রে থেরেসা মে নিজেও আবার সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারবেন না। এর জন্য তাকে দ্বারস্থ হতে হবে সংসদের। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন পেলে তখন তিনি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারবেন।
এ সংক্রান্ত প্রস্তাব সংসদে পাস হওয়ার ২৫ কার্যদিবস পর সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ফেলা যাবে। সেক্ষেত্রে থেরেসা মে ২৫ কার্যদিবসের পরের যেকোনো দিন নির্ধারণ করতে পারেন। তবে এই তারিখ নির্ধারণের জটিলতার কারণে ফের আর্টিকেল ৫০ অনুযায়ী ব্রেক্সিট কার্যকরের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
এই কয়েকটি সম্ভাব্য পথের বাইরেও বিকল্প রয়েছে থেরেসা মে সরকারের হাতে। যেমন— ব্রিটেন চাইলে ফের ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফেরতও আসতে পারে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস যেমন এক আদেশে বলেছেন, যুক্তরাজ্য এককভাবে আর্টিকেল ৫০ প্রত্যাহার করে ব্রেক্সিট বাতিল করতে চাইলে তা বেআইনি হবে না। সেক্ষেত্রে ইইউভুক্ত ২৭ দেশের সঙ্গে নতুন করে কোনো চুক্তি বা এসব দেশের সম্মতিরও প্রয়োজন হবে না। তবে শুরু থেকেই মে সরকার যেভাবে ব্রেক্সিটের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে, তাতে ব্রেক্সিট বাতিল করে ফের ইইউতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে নতুন করে গণভোট কিংবা নতুন সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে পটপরিবর্তন না হলে ব্রিটেনের ইইউতে ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
এদিকে, নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টিতে অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবিলা করে জিতে আসায় আগামী ১২ মাসে অন্তত নিজ দলের ভেতের নেতৃত্বের পরীক্ষা দিতে হবে না থেরেসা মে’কে। তবে যেকোনো মুহূর্তে নিজ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন তিনি। ব্রেক্সিট ইস্যুতে নিজের ও দলের অবস্থানের পক্ষে জয় আনতে ব্যর্থ হলে সেটাই বরং তার জন্য নিরাপদ হবে। তখন আবার কনজারভেটিভ পার্টিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নতুন কাউকে খুঁজতে হবে, ঠিক যেমন উত্তরসূরী ডেভিড ক্যামেরনের পদত্যাগের পর খুঁজে আনা হয়েছিল মে’কে। অবশ্য মে নিজে না চাইলেও সংসদ সদস্যদের ‘সেনশিউর মোশনে’র চাপে পড়তে হলে সরে দাঁড়াতেই হবে থেরেসা মে’কে। সেক্ষেত্রেও নতুন প্রধানমন্ত্রী খুঁজতে হবে কনজারভেটিভ পার্টিকে। অনেকটা অনাস্থা প্রস্তাবের আদলে ‘সেনশিউর মোশন’ গোটা সরকারকেও চাপে ফেলতে বাধ্য করতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার— যা কিছুতেই বদল আসুক না কেন, ব্রেক্সিট নিয়ে তাদের নতুন করে ভাবতেই হবে।
(বিবিসি অবলম্বনে)
সারাবাংলা/টিআর