বি-যুক্ত রাজ্য?
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:০৩
।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।।
পার্লামেন্টে বিপুল ভোটে থেরেসা মে-র প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তি খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন বিরোধী নেতা, লেবার পার্টির জেরেমি করবিন। তবে কোনো মতে রক্ষা পেয়ে গিয়েছেন থেরেসা। আস্থা ভোটে তার পক্ষে ছিলেন ৩২৫ জন এমপি। বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৩০৬টি। অর্থাৎ মাত্র ১৯টি ভোট এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়েছে থেরেসার গদি। থেরেসার চুক্তির পক্ষে ভোট দেন মাত্র ২০২ জন এমপি। আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৪৩২টি। ব্রিটিশ সংসদীয় ইতিহাসে এত বড় হারের আর কোনো নজির নেই। ১৯২৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড পার্লামেন্টে ১৬৬টি ভোটে হেরেছিলেন। আর থেরেসা হারলেন ২৩০ ভোটে!
থেরেসা মে’র সরকার বেঁচেছে, কিন্তু যুক্তরাজ্য বাঁচবে তো? এমন প্রশ্ন উঠছে, লেখালেখি হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যুক্তরাজ্য এখন বি-যুক্তরাজ্যের পথে এগুচ্ছে। এখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ হলো ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া চালু করার সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়া। দু’বছর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন চুক্তির ৫০ নম্বর অনুচ্ছেদ সক্রিয় করে ব্রিটেন জানিয়েছিল, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে মাত্র ৭০ দিনে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে গেলে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিকদের কী হবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ব্রিটিশ ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলো কি ধরনের সুবিধা পাবে, এসবই এখন আলোচনার বিষয়।
‘Chaos everywhere, consensus nowhere’ – এমন এক অবস্থা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হতে গিয়ে ব্রেক্সিট যেন যুক্তরাজ্যকে টুকরো করে ফেলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্রেট ব্রিটেন আর উত্তর আয়ারল্যান্ডের সমন্বয়ে যে ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য তা আসলে এক কৃত্রিম বন্ধন। ভিন্ন সংস্কৃতি, ইতিহাস আর জাতীয় পরিচয়কে জোর করে ধরে রেখে এতদিনের একসাথে পথ চলা আর চলছেনা। একদম শুরুর দিকে, সাধারণ মানুষের ইচ্ছায় এই একসঙ্গে চলার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়নি, হয়েছিল অভিজাত শ্রেণির বাণিজ্যিক স্বার্থে। সতের শতকের শেষে, অষ্টাদশ শতকের শুরুতে স্কটিশ শাসক শ্রেণির স্বার্থে ইংল্যান্ডের সাথে স্কটল্যান্ডের মিলনের মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেন সৃষ্টি হয়। তবে এর পথ সহজ ছিলনা। বহু দাঙ্গা আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ১৭০৭ সালে সেই ইউনিয়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্কটল্যান্ড আর ইংল্যান্ড – দুই দেশেরই অভিজাত শ্রেণির জন্য এই চুক্তি ছিল বাণিজ্যিক ও কৌশলগত দিক থেকে লাভজনক। বিশেষ করে মধ্য আমেরিকার পানামায় ১৭ শতকের শেষ দিকে উপনিবেশ গড়তে ব্যর্থ স্কটিশরা মূলত দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল। আর ইংলিশরা চেয়েছিল স্কটল্যান্ড যেন ফরাসীদের খপ্পরে না চলে যায়। অবশ্য এর আগেই ১৫ শতকে ওয়েলস ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়। ১৮০১-এ আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত হয় গ্রেট ব্রিটেনের ইউনাইটেড কিংডম। তবে, দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে ১৯২২ সালে ২৬টি কাউন্টির মধ্য ২০টির সমন্বয়ে দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড ১৯৪৮ সালে যুক্ত হলেও উত্তর ৬টি কাউন্টি উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে আলাদা থেকে যায়। এবং এটিই আজকের ইউনাইটেড কিংডম ও উত্তর আয়ারল্যান্ড।
যে যুক্তরাজ্য ছিল শিল্পে সমৃদ্ধ সেই যুক্তরাজ্য আজ আর নেই। প্রভাবশালী শ্রেণির ঐক্যের জায়গাটা ছিল কয়লা খনি, ইস্পাত শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্প। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গড়তে এই শ্রেণিই উদ্যোগী ছিল। তবে যুক্তরাজ্যে লড়াকু শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য ছিল বরাবরই দৃঢ়। আশির দশকে মার্গারেট থেচার এই ঐক্য ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হন। তার বাজার অর্থনীতি ব্রিটেনকে শিল্প রাষ্ট্র থেকে সেবা অর্থনীতিতে পরিণত করে যার মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় আর্থিক খাত। সেটিও আজ শক্তি হারিয়েছে। দেশটির শ্রমিক আন্দোলন, যার বড় ভিত্তি ছিল লেবার পার্টি, ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই লেবার পার্টিরই সোশ্যালিস্ট নেতা জেরেমি করবিন।
ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট বেশি পাওয়ার নানা বিশ্লেষণ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ইংল্যান্ডের উত্তর ও মধ্যভাগে সেই অর্থে কখনও কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কৃচ্ছ্রতা সাধনের ঠেলায় এরা ব্রেক্সিটের পক্ষে। স্কটল্যান্ডের ৩২ স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিটিই ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে। ওয়েলস ব্রেক্সিটের পক্ষে ছিল, অন্যদিকে, উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি অংশ চেয়েছে ইইউতে থাকতে।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, নানা সময়ে, নানাভাবে, নানা কারণে যুক্ত থাকতে বাধ্য হলেও সাধারণ মানুষ এখন বিভাজিত। যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন এক ইল্যুশন হয়ে একত্রে ছিল, সময় হয়েছে বিযুক্ত হওয়ার। ব্রেক্সিট বিতর্ক হয়ত সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
সারাবাংলা/জেএএম