নিজের ঘরেই প্রতি তিনজন নারীর দুই জন সহিংসতার শিকার
১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:১৮
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বাংলাদেশের নারীরা পারিবারিকভাবেই বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এরমধ্যে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুইজনই সহিংসতার শিকার। এসব সংবাদ গণমাধ্যমে ঠিকমতো আসছে না। গণমাধ্যমে ঘরের বাইরের সহিংসতা ও যৌন সহিংসতা যতটা গুরুত্ব পায়, পারিবারিক সহিংসতা ততটা গুরুত্ব পায় না। বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের হল রুমে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ওপর দৃষ্টিপাত: প্রবণতা ও সমাধান’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণার ফলে জানানো হয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত ৭৫ শতাংশ প্রতিবেদনই ধর্ষণ বা গণধর্ষণ সম্পর্কিত। অথচ বেশিরভাগ সহিংসতাই পারিবারিক সহিংসতা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সহিংসতার শিকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ আদালতে শুনানির পর্যায়ে যায় না। গেলেও তা বাতিল হয়ে যায়। সহিংসতায় ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র তিন দশমিক এক শতাংশ নিজেদের পক্ষে বিচার পেলেও মামলা খারিজ বা অপরাধীকে খালাশ করে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে ৩২ শতাংশ।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু ১০ দশমিক সাত শতাংশ মামলা থাকে পারিবারিক বিরোধ সংক্রান্ত, যেখানে বেশিরভাগ অভিযোগ পারিবারিক সহিংসতা সম্পর্কিত।
একই অনুষ্ঠানে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ: সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক আকে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাও মানছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই নারীর নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন হুমকিতে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে গবেষণা দুটি উপস্থাপন করেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন।
কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘আইন থাকার পরও রয়েছে প্রতিবন্ধতা। এই প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করার লক্ষ্যেই এই গবেষণা। নারীরা সহিংসতার শিকার হওয়ার পরও স্বীকার করেন না। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, বিচার প্রক্রিয়ায় হয়রানি, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, সুশাসনের অভাব ও মামলা পরিচালনায় অতিরিক্ত খরচ নারীদের নিরুৎসাহিত করে মামলা বা অভিযোগ করতে।’
নারীরা ঘরেই বেশি অনিরাপদ উল্লেখ করে কাশফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘তবে পারিবারিক সহিংসতার মামলাগুলো ঠিকমতো সম্মুখে আসছে না। তাই নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে শিক্ষা ও কর্ম পরিসরে অংশগ্রহণ নিতে হবে।’
দেশের ২০টি জেলার ২ হাজার ৮০০টি সহিংসতার ঘটনার ওপর এই গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, গণমাধ্যমে ঘরের বাইরের সহিংসতা ও যৌন সহিংসতা যতটা গুরুত্ব পায়, পারিবারিক সহিংসতা ততটা গুরুত্ব পায় না। অথচ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার সবচেয়ে ব্যাপক রূপ হচ্ছে পারিবারিক সহিংসতা।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. সামিয়া হক বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার প্রভাব গিয়ে পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপরও। শিক্ষামাধ্যমে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরির বড় সুযোগ রয়েছে। পাঠ্যবই-এর সাহায্যে নারীর অধিকার বিষয়ে তার বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিতে কাজ করা যেতে পারে। আইনের বাস্তবায়নের অভাবে সচেতনতা থাকা সত্ত্বেও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।’
অনুষ্ঠানে বাংলা ট্রিবিউন-এর বার্তা প্রধান হারুন-উর রশিদ বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবেদন উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের নীতিমালায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। শব্দচয়নেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। দেশের আইন ব্যবস্থায় যে জটিলতা রয়েছে, ন্যায়-বিচার নিশ্চিতে তারও সংস্কার প্রয়োজন।’
এদিকে, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ: সুপ্রিম কোর্টের ২০০৯ সালের নির্দেশনার প্রয়োগ ও কার্যকারিতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন। দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ প্রণয়নের নয় বছর পরেও প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দেশনা অনুযায়ী কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ২০০৯ সালের সুপ্রিম কোর্টের দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নয়, কর্মক্ষেত্রে যার হার ৬৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্দেশনা সম্পর্কে জানলেও তাদের এ বিষয়ে কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে রয়েছে কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা ও নির্দেশ না মানার ঝোঁক।
এ বিষয়ে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল করিম এনডিসি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে ও নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে এবং নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগেলো পুরুষ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া বেশিরভাগ সময়ই ব্যাহত হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সহিংসতা বা হয়রানি প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি থাকতে হবে। অভিযোগ নেওয়ার পদ্ধতিকে আরও সহজ করার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে হবে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও সামাজিক ব্যাধি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়েনি। কর্ম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষদের সচেতন করতে হবে। বিচার নিশ্চিতের জন্য সামাজিকভাবে একটি চাপ দিতে হবে। ’
অনুষ্ঠানে সব ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনুষ্ঠানে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শিক্ষার্থীদের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা সম্পর্কে সচেতন করা। এ লক্ষ্যে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ, প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা, ব্যবহারিক ও প্রচারণার নথিপত্র তৈরি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তদারকি কৌশল গ্রহণ, গণপরিসরে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সরকারের ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারের ডেপুটি কমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, একশনএইড বাংলাদেশ-এর বোর্ড মেম্বার ড. খলিলুর রহমান, ডেপুটি ডিরেক্টর ফারিয়া চৌধুরী প্রমুখ।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ