অনিশ্চিত বিশ্ব ইজতেমা
১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৪০
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের (সা’দপন্থী ও সা’দবিরোধী) সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কারও সঙ্গেই সম্পর্ক না রাখার ঘোষণা দিয়েছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানি স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান ফটক ‘বাবুজ জাহের’-এর নোটিশ বোর্ডে এই সংক্রান্ত নোটিশও টানানো হয়েছে।
এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো নিষেধাজ্ঞা জারি করলো দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। এর আগেও একই সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের আগস্টে তাবলিগের সব কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয় দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবারের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘প্রিয় ছাত্ররা, দিনের প্রচার ও প্রসারের কাজ আমাদের ওপর ফরজ। তবে তাবলিগ জামাতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সৃষ্ট ফেতনা থেকে দারুল উলুমকে বাঁচানোর জন্য কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে যে, দারুল উলুমের কোনো ব্যক্তি তাবলিগের দুই পক্ষের কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। এ জন্য প্রিয় ছাত্ররা, দারুল উলুমের (দেওবন্দের) চৌহদ্দির ভেতর ও বাইরে তাবলিগ জামাতের চলমান সংকট নিয়ে মাথা ঘামাবে না। যদি দারুল উলুমের (দেওবন্দের) কোনো ছাত্র কিংবা বহিরাগত কেউ দারুল উলুমের (দেওবন্দের) চৌহদ্দির ভেতর চলমান সংকটের ব্যাপারে মাথা ঘামায়, তাহলে অন্য ছাত্ররা এতে (নিজেদের) না জড়িয়ে কর্তৃপক্ষকে দ্রুত জানাবে। যদি কোনো ছাত্র আইন অমান্য করে কোনো নিষিদ্ধ বিষয়ের সঙ্গে লিপ্ত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের গাজীপুরের টঙ্গীতে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত অনিশ্চিত হয়ে গেলো। কারণ দুই পক্ষের রেষারেষিতে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না বাংলাদেশের তাবলিগের মুরব্বিরা। তখন কাকরাইল মসজিদে উভয়পক্ষের মুরব্বিদের মধ্যে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের দেওবন্দে গিয়ে পরামর্শ নিয়ে ইজতেমার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে উভয়পক্ষের চারজন প্রতিবিধি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চার জন প্রতিনিধির ১৫ জানুয়ারি দেওবন্দে যাওয়ার কথা ছিল।
ভারতের দেওবন্দ যাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার (১৭ জানুয়ারি) রাতে সা’দবিরোধী পক্ষের কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের (বেফাক) সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘১৫ জানুয়ারি ভিসা জটিলতার কারণে দেওবন্দে যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়নি। আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল দেওবন্দে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ভিসাও হয়েছে। প্রতিনিধি দলে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব আনিসুর রহমান, পুলিশের ডিআইজি মনিরুজ্জামান ও সা’দপন্থী চার জন ও সা’দবিরোধী চার জনসহ মোট ১১ জন রয়েছেন।’
দেওবন্দ মাদ্রাসায় তাবলীগ জামাতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জারি করা নোটিশের ব্যাপারে জানতে চাইলে মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে প্রতিনিধি দল দেওবন্দ গিয়ে ফিরে আসলেই ইজতেমা নিয়ে আলোচনা হবে।’
এ ব্যাপারে সা’দপন্থী মাওলানা আশরাফ আলী বলেন, ‘সা’দ বিরোধীরা ১৯, ২০, ২১ জানুয়ারি ও ২৬, ২৭, ২৮ জানুয়ারি—এই দুই ধাপে টঙ্গীতে যে ইজতেমা করার কথা ছিল, গত ৬ জানুয়ারির বৈঠকে তা বাতিল করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দেওবন্দ গিয়ে সেখানের মুরব্বিদের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হবে।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ ডিসেম্বর টঙ্গীতে ইজতেমার আয়োজনকে কেন্দ্র করে মাওলানা সা’দপন্থী ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সংঘর্ষে তাবলিগ জামাতের দুই জন নিহত হন। এ ঘটনায় দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে। দুই পক্ষ সংবাদ সম্মেলনও করে। এরই মধ্যে জানুয়ারির ১৯ থেকে ২১ ও ২৬ থেকে ২৮ জানুয়ারি—দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের ঘোষণা দেন সা’দবিরোধীরা। তবে এই সময়ে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের জন্য তুরাগ তীরের ময়দান ব্যবহার না করতে দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেন মাওলানা সা’দের অনুসারীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পক্ষকেই তুরাগ ময়দান ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।
এরও আগে, গত বছর বিশ্ব ইজতেমার প্রধান ইমাম মাওলানা সাদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে দুইভাগে ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা। ওই সময় মাওলানা সা’দ দিল্লি থেকে এসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকা পড়েন। ওই সময় বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে সা’দবিরোধীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে মাওলানা সাদকে সুরক্ষা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টর ভেতর দিয়ে কাকরাইলে পৌঁছে দেয় পুলিশ। এ নিয়ে কয়েকদিন কাকরাইল মসজিদের আশেপাশে দুই পক্ষের অনুসারীদের সংঘর্ষ বাধে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে মাওলানা সা’দকে দিল্লিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এ ঘটনা নিয়ে প্রায় সারাবছরই দুই পক্ষের অনুসারীদের কোনো না কোনো ঝামেলা বেঁধেছে। কাকরাইল মসজিদে একপক্ষ আরেক পক্ষকে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে পুলিশ কখনো কখনো কাকরাইল মসজিদে দুই পক্ষের কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়নি।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘তাবলিগ জামাত নিয়ে ২০১৮ সালে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। আমরা চাই দুই পক্ষ বসে বিষয়টি সুরাহা করুক।’ বৈঠকের মাধ্যমে সুরাহা না হলে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
এদিকে, বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ওয়াই এম বেলালুর রহমান বলেন, ‘তাবলিগ জামাত এই মুহূর্তে দুভাগে বিভক্ত হয়ে একে অন্যকে দোষারোপে ব্যস্ত রয়েছে। টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার মাঠ পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। এ অবস্থায় কোনো এক পক্ষকে ইজতেমা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। দিলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যেতে পারে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দুই পক্ষ বসে যদি আলাদা সময়ে ইজতেমা করতে চায়, তাহলে বিষয়টি নিয়ে ভাবা যাবে। আবার দুপক্ষ বসে একইসঙ্গে ইজতেমা আয়োজন করতে চাইলেও কোনো সমস্যা থাকবে না। দেশে সা’দবিরোধীদের সংখ্যাই বেশি।’ তাই কাউকে ক্ষেপিয়ে কাউকে সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না বলেও তিনি মনে করেন।
সারাবাংলা/ইউজে/এমআই/এমএনএইচ