স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকা: টাঙানো হয়নি নামি হাসপাতালেও
২১ জানুয়ারি ২০১৯ ১০:৩১
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা টাঙানোর। ওই নির্দেশনার পর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় ছয়মাস। রাজধানীর বেসরকারি অনেক হাসপাতালে এখনও যথাযথ স্থানে টাঙানো হয়নি এই মূল্যতালিকা। সম্প্রতি রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলো ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুলাই উচ্চ আদালত দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্যতালিকা টাঙানোর নির্দেশ দেন। নির্দেশ দেওয়ার দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে ওই আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
আরও পড়ুন : হাসপাতাল ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য তালিকা টানাতে হবে
রাজধানীতে ঘুরে বেসরকারি হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতাল, বিআরবি হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, ইনসাফ হাসপাতাল, নগর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ইউনাইটেড হাসপাতালে মূল্য তালিকা টাঙানো দেখা গেলেও স্কয়ার হাসপাতাল, গ্রিনরোডে অবস্থিত গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে মূল্য তালিকার দেখা মেলেনি। দেখা যায়নি স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা শিশু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও বারডেম হাসপাতালেও।
রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে অবস্থিত সেন্টাল হাসপাতালে গিয়ে হাসপাতালের নিচতলায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা টাঙানো না দেখে অভ্যর্থনা টেবিলে মূল্য তালিকার বোর্ড কোথায় জানতে চাইলে দায়িত্বরত নারী জানালেন, তাদের কোথাও বোর্ড নেই। নির্ধারিত কাউন্টারে গিয়ে জেনে নিতে হবে।
তবে বোর্ড না থাকার কথা জানতে চাইলে সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরপরই আমরা মূল্যতালিকার বোর্ড টানিয়েছি। যারা আদালতের নির্দেশনা মানেন না, তারা তো আদালত অবমাননা করছেন। আমি সবসময়ই আইন মানা লোক। তাই এ নির্দেশনা না মানার কোনও সুযোগ নেই।’
তবে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা মেলে মূল্যতালিকার বোর্ড। কিন্তু সে বোর্ডের লেখা এতই ছোট যে খুব কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে না দেখলে সে তালিকার কিছু বোঝা সম্ভব নয়। এ প্রতিবেদক যখন বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মূল্য দেখার চেষ্টা করছে, তখন অপেক্ষায় থাকা একজন রোগী পাশ থেকে বলেন, বোর্ডের সামনে গিয়া চশমা দিয়ে কষ্ট কইরা লেখা পড়তে হবে। তারচেয়ে ভালো কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করা।
স্কয়ার হাসপাতালে গিয়ে মূল্যতালিকা নিয়ে জানতে চাইলে নিচতলায় অবস্থিত অভ্যর্থনা বিভাগ থেকে জানানো হয়, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে খোঁজ নিতে বললেন। দ্বিতীয় তলার নির্ধারিত ডেস্কে জানতে চাইলে দায়িত্বরত ব্যক্তি পাশের রিপোর্ট ডেলিভারি ডেস্কে গিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। সেখানে গিয়ে মূল্যতালিকা কোথায় জানানো রয়েছে, জানতে চাইলে জানানো হয়, এ হাসপাতালে কোথাও মূল্যতালিকা টাঙানো নেই। তবে তাদের কম্পিউটারে রয়েছে। কোনও পরীক্ষার মূল্য কত কেউ জানতে চাইলে তারাই সেটা জানিয়ে দেন।
একই অবস্থা গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালেরও। এই হাসপাতালে গিয়েও মূল্যতালিকার বোর্ড দেখা যায়নি। তবে মিরপুর রোডে অবস্থিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে গিয়ে মূল্যতালিকা পেলেও সেটি যথাযথ স্থানে টাঙানো হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘এই হাসপাতালে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার অনেক আগে থেকেই মূল্য তালিকা টাঙানো রয়েছে। তবে হাইকোর্ট তো আমাদের এ নির্দেশনা দেননি। দিয়েছে সরকার।’
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের হাসপাতালে সবকিছু অত্যন্ত সস্তা। যদি না থেকে থাকে, তবে আমি কাল চেক করে ব্যবস্থা নেব।’
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশীদ-ই-মাহবুব সারাবাংলাকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এখানে বেশকিছু বিষয় রয়েছে। মন্ত্রণালয় যদি প্রতিটি পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করে না দেয়, তাহলে হাসপাতালগুলো নিজেদের মতো করেই দাম নেবে। যা তারা এযাবতকাল করে এসেছে। আসলে দরকার, মন্ত্রণালয় থেকে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া, যেন রোগীরা তার সুফল পান।’
ডা. রশীদ-ই-মাহবুব আরও বলেন, ‘আর এজন্য দরকার সব ধরনের পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করে একটি কমিটি গঠন করা। যারা এই বিষয়টি তদারকি করবেন, দেখাশোনা করবেন।’
এদিকে, ঢাকা শিশু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবু তৈয়ব বলেন, ‘শিশু হাসপাতালে কোন কোন পরীক্ষা করা হয়, তার তালিকা থাকলেও কোন টেস্টের জন্য কত টাকা দিতে হবে, সে বিষয়ে কোনও তালিকা করা নেই।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘চার থেকে পাঁচদিন আগে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছি উচ্চ আদালতের রেজিস্ট্রার বরাবর। এছাড়া হাসপাতালগুলোকেও চিঠি দিয়েছি। ‘ শিগগিরই বিষয়টি কার্যকর হয়ে যাবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জুলাই দেশের সব বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল, ল্যাবেরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্যপরীক্ষার মূল্যতালিকা দৃশ্যমান জায়গায় টাঙানোর নির্দেশ দেন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। হিউম্যান রাইটস ল’ইয়ার্স অ্যান্ড সিকিউরিং এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি অব বাংলাদেশের পক্ষে কোষাধ্যক্ষ মো. শাহ আলমের দায়ের করা এই সংক্রান্ত এক রিটের শুনানি শেষে আদালত ১৫ দিনের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে এ আদেশ বাস্তবায়ন করার আদেশ দেন।
রিটে ৩০ দিনের মধ্যে সব প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যন্ত্রপাতিসহ তালিকা দাখিল, সব জেলা সদরের হাসপাতালে ৩০ বেডের আইসিইউ/সিসিইউ স্থাপন, মেয়াদহীন ওষুধ ব্যবহারে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিএসটিআই অনুমোদিত ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নির্দেশনা চাওয়া হয়। ওই রিট শুনানি শেষে আদেশসহ রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ