সিন্ডিকেটের নজর এবার তেল-চিনি-ডাল-পেঁয়াজে, বাড়ছে দাম
২২ জানুয়ারি ২০১৯ ০৬:৩৩
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চালের পর এবার দেশীয় বাজারে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে পাইকারি বাজারে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি ও পেঁয়াজের দাম গত এক সপ্তাহে কেজি প্রতি কমপক্ষে ৫ টাকা বেড়েছে।
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এই যুক্তি মানতে নারাজ। তারা বলছেন, নির্বাচনের পর পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, মিল মালিক ও ডিলাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তেল ও চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দেশের অন্যতম বড় ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ঘুরে দাম বাড়ার এই চিত্র পাওয়া গেছে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ টাকায়। ৭০ টাকা বেড়ে সেই তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯শ টাকায়। ডিসেম্বরে সুপার সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ১৩০ টাকায়। প্রতি মণে ১৫০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৮০ টাকায়। ওই সময় পাম অয়েলের দাম ছিল ১ হাজার ৯৫০ টাকায়, ১২০ টাকা বেড়ে এখন এর দাম ২ হাজার ৭০ টাকা।
ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী খাতুনগঞ্জের আর এন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, গত ১০ দিনে কেজি প্রতি ভোজ্যতেলের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে। মিল মালিকরা আমাদের নতুন করে তেল দিচ্ছে না। আগে কেনা তেলই আমরা বিক্রি করছি। অথচ তাদের কাছে পর্যাপ্ত তেল আছে। তারা বলছে, ডলারের রেট বেড়ে গেছে। এখন আগের রেটে তেল বিক্রি করা যাবে না। বুকিং রেটে যেহেতু ঊর্ধ্বগতি, স্বাভাবিকভাবেই বাজারে এর প্রভাব পড়ছে।
দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার বড় অংশের জোগান দেয় তিনটি বড় শিল্প গ্রুপ। এর মধ্যে রয়েছে এস আলম, টি কে গ্রুপ ও সিটি গ্রুপ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাধারণ ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সারাবাংলাকে বলেন, মিল মালিকরা তেল ছাড়ছে না, এটা সত্যি। একইভাবে আগে বুকিং দেওয়া তেল বড় ডিলার ছাড় করাচ্ছেন না, এটাও সত্যি। অর্থাৎ বাজারে একটা সংকট তৈরিই মূল লক্ষ্য। এই সুযোগে কয়েকশ কোটি টাকা মুনাফা হবে।
‘শীত মৌসুমে পাম অয়েল জমাট বেঁধে যায়। এ সময় পাম অয়েলের চাহিদা থাকে না। তাহলে এই পাম অয়েলের দামও বাড়ছে কেন? আর শীতের শুরুতে সয়াবিন তেলের দাম প্রতিবছর বাড়ে। শীতের বিদায় ঘনিয়ে এলে দাম পড়ে যায়। এবার নির্বাচনের আগে শীত শুরু হয়েছে। অথচ তখন দাম বাড়েনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে’,— বলেন ওই ব্যবসায়ী।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, খাতুনগঞ্জের সোনা মিয়া মার্কেটের তিনটি এবং বাদশা মিয়া মার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠান ভোজ্যতেলের সংকট তৈরির সঙ্গে জড়িত। এদের পেছনে মিল মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
সরবরাহ ঘাটতি দেখিয়ে বাড়ানো হচ্ছে চিনির দামও। প্রকারভেদে প্রতি মণে চিনির দাম বেড়েছে ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা। এই মুহূর্তে খাতুনগঞ্জে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ১ হাজার ৭২০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৬৮০ থেকে ১ হাজার ৬৯০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স এশিয়া করপোরেশনের মালিক অনিল চন্দ্র পাল সারাবাংলাকে বলেন, মিল মালিক যদি চিনি না দেয়, আমরা কোত্থেকে বিক্রি করব? তারা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে গেছে। আমরাও দেখছি ডলারের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। এই অবস্থায় আমরা তো পুঁজি হারাতে বসেছি।
দেশের পরিশোধিত চিনির বড় অংশের জোগান দেয় এস আলম গ্রুপ। সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিল থেকে পর্যাপ্ত চিনি ছাড় হলেও খাতুনগঞ্জভিত্তিক একটি বড় ডিলার গ্রুপ সেই চিনি বাজারে আসতে দিচ্ছে না। তাদের মজুত করা চিনি বাড়তি দামে বিক্রি করে তারা মুনাফা করছে।
একইভাবে ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বাড়ছে মসুর ও মুগ ডালের দাম। গত সপ্তাহের মসুর ডাল কেজি প্রতি ৭৫ টাকা ও মুগ ডাল কেজি প্রতি ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সোমবার (২১ জানুয়ারি) খাতুনগঞ্জে মুগডাল ৭৫ টাকা ও মসুর ডাল ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ডাল আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের পরিচালক সোলায়মান বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ৮৩ ডলারে ডাল বুকিং দিয়েছিলাম। এখন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা থেকে ৮৬ টাকায়। স্বাভাবিকভাবে আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ডলারের সংকট ঠিক না হলে বাজার স্বাভাবিক হবে না।’
তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখন যেসব ডাল বিক্রি হচ্ছে তা কমপক্ষে তিন মাস আগে বুকিং দেওয়া। ডলারের দাম বেড়েছে গত এক সপ্তাহে। সুতরাং ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে বাজারে ডালের দাম বাড়ানোর বিষয়টি সঠিক নয়।
ভারতের বাজারে অস্থিরতার অজুহাত তুলে পেঁয়াজের দামও খাতুনগঞ্জের বাজারে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। সোমবার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজি প্রতি ১৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও এই দাম ছিল ১২ থেকে ১৩ টাকা।
পেঁয়াজ আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের মেসার্স হাজী অছি উদ্দিন সওদাগরের মালিক মো. রহুল আমিন চৌধুরী রিগ্যান সারাবাংলাকে বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ কম আসছে। সে দেশের বাজারেও পেঁয়াজের দাম বাড়তি। সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৫০-৬০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢোকে। গত ২-৩ সপ্তাহ ধরে দিনে ২০ ট্রাকের বেশি পেঁয়াজ আসছে না।
তবে খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে কমেছে চীনের আদা ও রসুনের দাম। তিন দিন আগে প্রতি কেজি একশ টাকায় বিক্রি করা আদা সোমবার ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রসুন রোববার বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়। একদিনের ব্যবধানে সোমবার দাম ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়।
নির্বাচনের পরপর অস্থির হয়ে ওঠে দেশের চালের বাজারও। দুই সপ্তাহ আগে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) একশ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। ঊর্ধ্বগতির পর বর্তমানে চালের বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/এটি