বিএনপিতে আগে পুনর্বাসন, পরে পুনর্গঠন
২২ জানুয়ারি ২০১৯ ২১:৩৩
।। আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘মহাবিপর্যয়’ কাটিয়ে তৃণমূল ও মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে এই মুহূর্তে পুনর্বাসনকে প্রাধান্য দিচ্ছে বিএনপি। আর পুনর্গঠনের ব্যাপারে কোনো রকম তাড়াহুড়ো করতে চায় না দলটি। এ জন্য অন্তত এক বছর সময় নেওয়া পক্ষে দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর গত ১৮ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর আলোচনায় দলের দুই শীর্ষ নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শিগগিরই পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কথা বলেন।
ড. মোশাররফ বলেন, ‘এখন আমাদের প্রথম দরকার পুনর্বাসন। মামলা-মোকদ্দমা থেকে নেতাকর্মীদের মুক্ত করানো, যারা জেলে আছে তাদের মুক্ত করা, যারা আহত আছে, তাদের চিকিৎসা করানো। দ্বিতীয় কাজটি হলো দল ঘুরে দাঁড়াতে হলে একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে ত্যাগি-পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের নেতৃত্বে আনতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিতি হয়েছি, তাদের পদ ছাড়তে হবে তরুণদের জন্য। তাহলেই বিএনপি ঘুরে দাঁড়াবে।’
একই অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘এখন আমাদের জন্য দুটি কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনে যাওয়ার কারণে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও তাদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দ্বিতীয় কাজটি হলো, যারা দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের সামনের দিকে এনে দল পুনর্গঠন করতে হবে। দরকার হলে আমরা প্রবীণরা সরে যাব। তারপরও এই দলটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এই কাজ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে করতে হবে।’
কিন্তু দলটির বেশিরভাগ নেতা, বিশেষ করে যারা মাঠ গোছানোর দায়িত্ব পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে, তারা মনে করছেন, এই মুহূর্তে পুনর্গঠন নয়, ঘুরে দাঁড়াতে হলে পুনর্বাসনের দিকে নজর দিতে হবে বিএনপিকে। পুনর্বাসন কাজ শেষ হলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: ঘুরে দাঁড়াতে পুনর্বাসন-পুনর্গঠনের পক্ষে বিএনপির সিনিয়র নেতারা
বিএনপির অভিযোগ— একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার আগ মুহূর্তে গত বছর সেপ্টম্বর মাস থেকে হঠাৎ করে ‘গায়েবি’ মামলা শুরু হয়। সারাদেশে দায়ের হওয়া কয়েক হাজার মামলায় আসামি করা হয় কয়েক লাখ নেতাকর্মীকে। নির্বাচনের আগের রাত পর্যন্ত চলে ব্যাপক ধরপাকড়। কয়েক হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। হাজার হাজার নেতাকর্মী হন ঘরছাড়া। নির্বাচনি সহিংসতায় আহত হন অসংখ্য নেতাকর্মী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এমন পরিস্থিতে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের দ্রুত পুনর্বাসনের পাশাপাশি দল পুনর্গঠনের কথা বললেও ‘পুনর্গঠন’র বিষয়টিকে অনেকেই বাস্তব সম্মত মনে করছেন না। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে দল পুনর্গঠনে হাত দিলে অস্বস্তিতে থাকা নেতাকর্মীদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে।
তাছাড়া সারাদেশে কাউন্সিল ও ভোটের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন করতে হলে পুলিশ ও প্রশাসনের কাছ থেকে যে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হবে, সেটা এই মুহূর্তে পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু ধরপাকড় আরও বেড়ে যাবে। এসব কারণে এই মুহূর্তে পুনর্গঠনে হাত না দেওয়াই উত্তম বলে মনে করছেন তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
তারা বলছেন, এই মুহূর্তে যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটা হলো ঘরছাড়া নেতাকর্মীদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করা। কারাবন্দি নেতাদের কারামুক্তির ব্যবস্থা করা। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের আর্থিক সহযোগিতা করা। বিভিন্ন মামলায় আসামি হওয়া নেতাকর্মীদের দলীয়ভাবে আইনি সহায়তা দেওয়া। এ জন্য প্রয়োজনে টিম ও সেল গঠন করে কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা।
আরও পড়ুন: উপজেলা নির্বাচনে যাবে না বিএনপি, প্রার্থী হলেই বহিষ্কার
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তৃণমূল পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই মুহূর্তে পুনর্গঠনের চেয়ে পুনর্বাসনটা বেশি প্রয়োজন। নির্বাচন করতে গিয়ে আমাদের লাখ লাখ নেতাকর্মী বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের পুনর্বাসন না করে পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করা বাস্তব সম্মত হবে না। এরইমধ্যে আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের বাড়িতে সশরীরে গেছেন। তাদেরকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের এই কর্মসূচি অব্যহত থাকবে।’
মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, ‘হুট করে পুনর্গঠনে হাত দেওয়া যাবে না। গত সাড়ে ৪ বছর ধরে আমি এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি জানি কাজটা কঠিন। ইউনিয়ন পর্যায়ে একটা কাউন্সিল করতে গেলেও প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হয়, জায়গা পাওয়া যায় না। উপরন্তু আমাদের চেয়ারপারসন জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। এমন পরিস্থিতিতে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেওয়া কঠিন হবে। আমি মনে করি, এ জন্য আরও এক বছর সময় হাতে নিয়ে আমাদের এগোতে হবে।’
জানতে চাইলে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন—দুইটাই আমাদের কাছে এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে পুনর্বাসনটা ইমেডিয়েটলি প্রয়োজন। কারণ, আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী মানবেতর জীবনযাপন করছেন, তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে হবে। ’ পুনর্গঠনের সঙ্গে যেহেতু পলিসি মেকিংয়ের ব্যাপার জড়িত, সেহেতু একটু সময় নিয়ে করতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।
সারাবাংলা/এজেড/এমএনএইচ