Tuesday 08 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রামের প্রতিবাদী নারীকে মানতে না পেরেই ধর্ষণ!


২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১০:৫৫
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: হাসপাতালে ১৭ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের মধ্যমবাগ্গা গ্রামের সেই নির্যাতিত নারী।  স্থানীয়রা বলছেন, ভূমিহীন মানুষদের পক্ষে কথা বলে আগে থেকেই নির্যাতিত ওই নারী অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হন।  সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় প্রভাবশালী রুহুল আমীনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষেও কাজ করেছিলেন তিনি। তার চরিত্রের এমন অনমনীয়তার কারণেই তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকূলতাকে জয় করা নারীরা সবসময়ই সমাজের প্রভাবশালীদের চোখের কাঁটায় পরিণত হন।  তাই এ ধরনের নারীকে সমাজে হেয় করার হীনউদ্দেশ্যে পরিবারকে সামাজিক পীড়নের মধ্যে রাখতে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয় অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে।  বাগ্গা গ্রামের ওই নারীকেও এরই শিকার হতে হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

৩০ ডিসেম্বর ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ধানের শীষে ভোট দেওয়ার কারণে সেই রাতে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে সুবর্ণচরের ৪০ বছরের এক নারীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পরদিন তার স্বামী ৯ জনের নাম উল্লেখ করে চরজব্বর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় এ পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয় জনসহ ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে, হাসপাতালে ১৭ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন ওই নারী। এরই মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষায় তাকে গণধর্ষণের আলামত মিলেছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার নারী ওই এলাকার ভূমিহীন সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে ভূমিহীনদের পক্ষে লড়াই করে আসছেন। নিজেদের অধিকার আদায়ের যেকোনো ইস্যুতে বা নিজেদের ওপর হওয়া যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে সবসময় সরব ছিলেন তিনি। আর এসব করতে গিয়েই রুহুল আমীনের সঙ্গে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব।

এদিকে, সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক (পরে বরখাস্ত) রুহুল আমীনের প্রতিপক্ষ ইব্রাহীম খলিলের পক্ষে কাজ করেছেন এই নারী। ওই নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন রুহুল আমীন। তার পরাজয়ের পেছনেও ওই নারীর ইব্রাহীম খলিলের পক্ষে কাজ করাকে কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকেই। তারা বলছেন, এসব মিলিয়েই রুহুল আমীনের শত্রু হয়ে পড়েন ওই নারী।

স্থানীয়রা বলছেন, এর সঙ্গে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার খেসারত হিসেবেই রুহুল আমীনের অনুসারীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হতে হয় তাকে।

সুবর্ণচরের ওই নারী মূলত তার প্রতিবাদী চরিত্রের কারণেই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘তিনি নারী না হয়ে একজন পুরুষ হলেও কিন্তু রুহুল আমীনদের প্রতিহিংসার শিকার হতেন। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই হোক কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই হোক, সমাজে এখন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে বিরুদ্ধ কণ্ঠকে প্রতিহত করতে হবে, সেটা যেভাবেই হোক। তিনি নারী না হয়ে পুরুষ হলেও তাকে কোনো না কোনো রূপে সহিংসতার শিকারই হতে হতো।’

নারীকে অবদমনের জন্য ধর্ষণকেই সমাজে সর্বোচ্চ শাস্তির মানসিকতা রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘পুরুষ হলে হয়তো তাকে মারা হতো। কিন্তু সামাজিক গড়নে নারীর ক্ষেত্রে ধর্ষণই তার সর্বোচ্চ শাস্তি। এর মাধ্যমে তাকে সমাজে অচ্ছুত করে দেওয়া যায়—পুরুষতান্ত্রিকতার জায়গা থেকেই এমন একটি ধারণা প্রচলিত আছে। নারীকে শাস্তি দিতে গেলে তাই সেটারই আশ্রয় নেওয়া হয়।’

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমীনও মনে করেন, ‘নারীকে থামিয়ে দেওয়ার অন্যতম অস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয় ধর্ষণকে। ’ তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নোয়াখালীর সুবর্ণচরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেন, অধিকার আদায়ে সচেষ্ট।  সেই নারীকে সমাজের কথিত প্রভাবশালীরা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটাই আমাদের সমাজে এতদিন হয়ে এসেছে এবং হয়েও চলেছে।’

দিলরুবা শারমীন বলেন, এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘বায়োলজিক্যাল ডিফারেন্স’কে খুব বড় করে দেখা হয়। গ্রামের একটা মেয়ে প্রতিবাদী হবে, অশিক্ষিত, অর্থহীন-বিত্তহীন ব্যক্তি প্রতিবাদী হবে, বিরোধী পক্ষের হয়ে কাজ করে জিতে যাবে— এটা মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা এখনও আমাদের গড়ে ওঠেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কোনোভাবে কোনো নারীকে যদি ‘ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট’করা যায়, তাহলে সেই নারী একধাপ হলেও পিছিয়ে যাবেন এবং কাজের অভিজ্ঞতার সূত্রে জানি, ঘটেও তাই।’’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজ কখনও পরিবর্তিত হয়ে ধর্ষণকেও অন্য নির্যাতন-নিপীড়নের মতো একটি নির্যাতন-নিপীড়ন হিসেবে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়, তখন হয়তো ধর্ষণ আর সমাজে নারীদের শায়েস্তা করার চূড়ান্ত অস্ত্র থাকবে না।  তখন হয়তো ধর্ষণের বদলে নারীকে অন্য কোনো নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হতো।

রাশেদা রওনক খান বলেন, ‘ধর্ষণ বিষয়টি যদি কখনো অন্য কাটা-ছেঁড়া-মারার মতো বিষয়ে পরিণত হয়, তাহলে হয়তো নারীরা এই অমানবিক বিষয় থেকে মুক্তি পেতে পারতো।’

উই ক্যান-এর নির্বাহী সমন্বয়ক জিনাত আরা হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধর্ষণ দিয়ে পুরুষরা একটি বার্তা দিতে চায়, তোমাকে আমি শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারি, সামজিকভাবে মর্যাদাহানি করতে পারি, মানসিকভাবে পীড়ন করতে পারি এবং সমাজের কাছে তোমারসহ তোমার পরিবারের মানসম্মান শেষ করতে পারি।’

জিনাত বলেন, ‘ধর্ষণ হয়তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু যে ধারণা থেকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, সেই ধারণা বদলে দেওয়ার কাজটি করতে হবে। ধর্ষণ অবশ্যই একটি ঘৃণ্য অপরাধ এবং এর বিচার হতেই হবে। কিন্তু একে যেভাবে দেখা হয়, সেই দেখার ধরণটা অগ্রাহ্য করতে হবে। ধর্ষণও একটি দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা— এমন ভাবনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ হবে না।

এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ধর্ষণের পরও জীবন চলতে পারে, এতে জীবনের কোনো ক্ষতি হয় না—এটা প্রতিষ্ঠিত হলেই ধর্ষণের শিকার নারীরাও প্রচলিত অর্থের অপমানজনক জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। এর জন্য আমাদের নিপীড়নের ঘটনায় মুষড়ে না পড়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। অমানবিকতার শিকার হয়েও পূর্ণিমা শীল যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে অন্যদেরও।

সারাবাংলা/জেএ/টিআর/এমএনএইচ

সুবর্ণচরে গণধর্ষণ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর