জরায়ুমুখ ক্যানসার : এইচপিভি টিকা, স্ক্রিনিং ও অন্যান্য
২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১৩:০৩
ডাঃ রাহনূমা পারভীন ।।
বাংলাদেশের নারীদের ক্যানসারের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসারের পরেই জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্থান। প্রতিবছর অসংখ্য নারী মারা যান এই রোগে। তবে সচেতন হলেই এই ক্যানসার প্রতিরোধ সম্ভব। আর স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসাতে প্রায় শতভাগ নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। চলুন জরায়ুমুখ ক্যানসারের কারণ ও প্রতিরোধের উপায়গুলো জেনে নিই।
জরায়ুমুখ ক্যানসার কেন হয়?
জরায়ুমুখের ক্যানসারের প্রধান কারণ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচ পি ভি)। যৌন সংস্পর্শের মাধ্যমে এই ভাইরাসটি সংক্রমিত হয়। এছাড়া আরও যে দশটি কারণে জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে তা হলোঃ
১। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া
২। নারীর বা নারীর পুরুষসঙ্গীর একাধিক অনিরাপদ যৌনসঙ্গী
৩। ধূমপান, জর্দা, সাদাপাতা, গুল বা অন্য কোন পদ্ধতিতে তামাকে আসক্ত নারী
৪। দীর্ঘদিন ধরে (৫ বছরের অধিক) জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়া
৫। ১৭ বছর বয়সের মধ্যে প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়া ও তিন বা তিনের অধিক সন্তান জন্মদান
৬। দীর্ঘদিন ধরে জরায়ুমুখে কোন ইনফেকশনে ভোগা (যেমন ক্ল্যামাইডিয়া ইনফেকশন)
৭। অপুষ্টি, শাকসবজি, ফলমূল না খাওয়া। আবার দেহের অতিরিক্ত ওজনও কিন্তু এই ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়
৮। যদি কোন কারণে কারও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যেমন এইডস বা এইচআইভি ইনফেকশন, শরীরে কোন অঙ্গ প্রতিস্থাপন, বা কোন অটো ইমিউন ডিজিজের ক্ষেত্রেও জরায়ুমুখ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে
৯। আর্থসামাজিক অবস্থা। অর্থাৎ দারিদ্র্যের কারণে সঠিক সময়ে চিকিৎসা করাতে না পারা
১০। পরিবারের রক্তের সম্পর্কের কারো জরায়ুমুখের ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে
বাল্যবিয়ের সাথে জরায়ুমুখ ক্যানসারের সম্পর্ক?
জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী এইচপিভি ভাইরাসটি সাধারণত যৌনক্রিয়ার সময় ত্বকের সংস্পর্শে ছড়ায়। এটি খুবই সাধারণ একটি ইনফেকশন। সারা বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ৯ জনই তাদের জীবদ্দশায় অন্তত একবার এইচপিভি দ্বারা আক্রান্ত হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ভাইরাস থেকে মুক্তি মেলে।
কিন্তু ভাইরাসটি শরীর থেকে পুরোপুরি নির্মূল না হলে তা থেকে জরায়ুমুখ, পুরুষাঙ্গ, এবং নারী-পুরুষ উভয়ের পায়ুপথ ও মুখ গহবরের বিভিন্ন অংশের ক্যানসার হতে পারে। আর যদি অল্প বয়সে এই ভাইরাসটি নারীর জরায়ুমুখে সংক্রমিত হয়, তাহলে তা থেকে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
গবেষণায় জানা গেছে, ২০ বছরের কম বয়সী নারীরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ইউনিসেফ এর পরিসংখ্যানে বাল্যবিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে আছে। আর অল্প বয়সে বিয়ে হলে জরায়ুমুখ ক্যানসারের অন্যান্য ঝুঁকির যে কারণগুলো উপরে বলা হলো, তার অনেকগুলোই অল্পবয়সী মেয়েরা ধারণ করে। ফলে বাংলাদেশের নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হারও অনেক বেশি! জরায়ুমুখের ক্যানসার প্রতিরোধের প্রথম পদক্ষেপ তাই হওয়া উচিৎ বাল্যবিয়ে রোধ করা।
এইচ পি ভি টিকা
সাধারণত, ৯ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে, যৌনক্রিয়ায় সক্রিয় হবার আগেই এই ভাইরসের টিকা নিতে হয়। তবে ১১ থেকে ১২ বছর বয়সে নেওয়া ভালো। যৌনক্রিয়ার সক্রিয় হবার পর, বিয়ে পরবর্তী জীবনে কিংবা বেশি বয়সে নিলে এই টিকা তেমন কার্যকর হয়না। ২৬ বছর বয়সের পর এই টিকার কার্যকারিতা নেই বললেই চলে।
মনে রাখতে হবে, টিকা নিলেও প্রতিটি নারীকে ২১ বছর বয়স থেকে, নিয়মিত জরায়ুমুখের স্ক্রিনিং এ অংশ নিতে হবে। কারণ এই টিকা ক্যানসারের টিকা নয়, এইচপিভি ভাইরাসের টিকা। এটি জরায়ুমুখের ক্যানসার শতভাগ প্রতিরোধ করতে পারেনা। তাই ক্যানসার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে স্ক্রিনিং করা খুবই জরুরী।
জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং
রোগের উপসর্গ প্রকাশের আগেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করার প্রক্রিয়াকে স্ক্রিনিং বলে। জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্ক্রিনিং টেস্টের নাম প্যাপস টেস্ট। এতে জরায়ুমুখ থেকে রস নিয়ে তাতে ক্যানসারের অস্তিত্ব আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়।
যৌনক্রিয়ায় সক্রিয় হবার পর, ২১-৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ৩ বছর পরপর এই পরীক্ষা করাতে হয়। যদি কেউ আরও পরে যৌনক্রিয়ায় সক্রিয় হয়, তাহলে তিনি তার ৩ বছর পর থকে এই পরীক্ষা করাবেন। এই পরীক্ষায় কোন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়লে তখন আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ক্যানসার আছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়।
এছাড়াও এইচপিভি ডিএনএ টেস্ট করা যায়, তবে তা সহজলভ্য নয় ও বেশ ব্য়য়বহুল। প্যাপস টেস্টের পাশাপাশি একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ দ্বারা তলপেট ও জরায়ু পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিৎ।
বাংলাদেশের সবজায়গায় ভায়া টেস্ট নামে একটি পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়। এটি জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্ক্রিনিং এর আগের পরীক্ষা। এটি করা থাকলেও কিন্তু প্যাপস টেস্ট করা জরুরী। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় জরায়ুমুখ ক্যানসারের কোন লক্ষণই থাকে না, এমনকি কোন ব্যথাও থাকেনা। তাই আমরা সবাই এই স্ক্রিনিংকে ভীষণ অবহেলা করি। অথচ লক্ষণ প্রকাশের আগেই রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসায় তা সহজেই নিরাময় করা যায়।
জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে আরও যা যা করণীয়
১। ১৮ বছরের পূর্বে সন্তান না নেওয়া
২। ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও যৌনবাহিত অন্যান্য রোগের বিষয়ে সচেতন থাকা
৩। যৌনসঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা, যৌন সংসর্গ বিষয়ে সচেতন থাকা ও যৌনমিলনে নিয়মিত কনডম ব্যবহার করা
৪। ধূমপানসহ জর্দা, গুল, সাদা পাতা তথা সব ধরণের তামাক পাতা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা
৫। প্রচুর পরিমাণ ফলমূল ও শাক সবজি খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রন করা
আমাদের সামান্য সচেতনতাই পারে জরায়ুমুখ ক্যানসারের মতো ভয়াবহ ব্যাধিকে প্রতিরোধ করতে। আসুন সবাই সচেতন হই, এই মরণব্যাধিকে জয় করি।
লেখক – মেডিসিন ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞ
সারাবাংলা/আরএফ/টিসি