‘লাগামহীন’ নিত্যপণ্যের বাজার, নেই পদক্ষেপ
২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ১৬:০৯
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের বাজারে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্যণের দাম গত একমাস ধরে লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি, আদা ও পেঁয়াজের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। বছরের শুরুতে হঠাৎ করে দাম বেড়ে যাবার দৃশ্যমান কোনো কারণ না থাকলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা নেই। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য থামাতেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
পাইকারি ব্যবসায়ীরাই বলছেন, সরকার যদি বাজারের উপর হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই দাম আরও লাগামহীন হয়ে পড়বে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারি কোনো সংস্থার প্রত্যক্ষ নজরদারি না থাকার কারণে বাজারে কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হচ্ছে। একটা জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, একইসঙ্গে নতুন বছর শুরু হয়েছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এই সময়টাকে ধরে বাজারে পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
শনিবার (২৬ জানুয়ারি) দেশের অন্যতম বড় নিত্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গড়ে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়ে যাওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে। পাঁচ ধরনের নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের যুক্তি এখনও আগের মতোই। তেল ও চিনির ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা জানুয়ারির শুরু থেকে সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন। ডাল, আদা-পিঁয়াজের ব্যবসায়ীরা অজুহাত দিচ্ছেন ডলারের দাম বাড়তি থাকার।
অথচ সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক সপ্তাহে ডলারের দাম স্থিতিশীল আছে। এরপরও দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিমণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ২৮৩০ টাকায়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২৯০০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ২৯৩০-২৯৫০ টাকায়।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সুপার সয়াবিন বিক্রি হয়েছিল ২১৩০ টাকায়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২২৮০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পামঅয়েল বিক্রি হয়েছিল ১৯৫০ টাকায়। গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ২০৭০ টাকায়। এ সপ্তাহে বিক্রি হচ্ছে ২১০০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের বাজারে এস আলম, টি কে গ্রুপ এবং সিটি গ্রুপের ভোজ্যতেল বিক্রি হয়। দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার বড় অংশের যোগান দেয় এই তিনটি বড় শিল্পগ্রুপ।
ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী খাতুনগঞ্জের আর এন এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী আলমগীর পারভেজ সারাবাংলাকে বলেন, মিল মালিকরা কেউ তেল দিচ্ছে না। ডিসেম্বরের শেষদিকে যেসব তেল পেয়েছিলাম, সেগুলো এখনও বিক্রি করছি। মিল মালিকরা জানুয়ারির শুরু থেকে তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার যদি তাদের উপর কোনো চাপ না দেয়, তাহলে ফেব্রুয়ারি থেকে দাম আরও বাড়বে।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ডিসেম্বরে কেনা তেল পাইকারি বাজারে বিক্রি করলেও সরবরাহ সংকটের সুযোগে সেই তেলের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি মণে চিনির দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত। এই মুহুর্তে খাতুনগঞ্জে চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ১৭১৫ টাকা থেকে ১৭২৫ টাকা পর্যন্ত। দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১৬৮০ থেকে ১৬৯০ টাকায়।
দেশের পরিশোধিত চিনির বড় অংশের যোগান দেয় এস আলম গ্রুপ। এছাড়া খাতুনগঞ্জের বাজারে তীর, সিটি গ্রুপের সিটি সুপার এবং মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনিও বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন খাতুনগঞ্জের মেসার্স এশিয়া করপোরেশনের মালিক অনিল চন্দ্র পাল।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই শিল্পগ্রুপগুলো বাজারে স্লো-সাপ্লাইয়ের একটা নীতি চালু করেছে। সামনে রমজান আছে। গরম আসছে। বেভারেজ কোম্পানিগুলোর চাহিদা বাড়বে। তারা ওই বাজারটা ধরতে গিয়ে এখন সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি হয়েছে, আগামী সপ্তাহ থেকে দাম আরও বাড়বে।’
খাতুনগঞ্জের বাজারে মসুর এবং মুগডালের দামও কেজিপ্রতি গত সপ্তাহের চেয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে।
শনিবার মসুর ডাল ভালো মানের প্রতিকেজি ৯০ টাকা, মাঝারি মানের ৮৫ টাকা এবং সাধারণ মানের মসুর ডাল ৪৭-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মুগডাল ভালো মানের প্রতিকেজি ১০২-১০৫ টাকা, মাঝারি মানের ৭৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডাল আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের তৈয়বিয়া ট্রেডার্সের পরিচালক সোলায়মান বাদশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে একেক ব্যাংক ডলারের একেক রেট নিচ্ছে। ৮৩ টাকা ৬০ পয়সায় যে ডলার কিনেছি, সেই ডলার গত সপ্তাহের ৮৫ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে হয়েছে। ৪৫০ ডলারে প্রতি টন ডাল ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে বুকিং দিয়েছিলাম। সেই ডাল এখন ৫২০ ডলারে কিনতে হচ্ছে।’
তবে সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত সপ্তাহের নতুন করে ডলারের দাম বাড়েনি। এছাড়া বাজারে এখন যেসব ডাল বিক্রি হচ্ছে সবই ৪৫০ ডলার কিংবা এর চেয়েও কম রেটে বুকিং দেওয়া।
পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্থিতিশীল আছে। খাতুনগঞ্জের বাজারে কোথাও ১ টাকা বাড়লেও কোথাও আবার ১-২ টাকা কমেছে।
শনিবার খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ টাকায়। গত সপ্তাহে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ডলারের দাম বেড়ে যাবার অজুহাতে নতুন করে বেড়েছে চীন-থাইল্যাণ্ডের আদার দাম। গত সপ্তাহে আদা বিক্রি হয়েছে ৭৫ টাকায়। শনিবার বিক্রি হচ্ছে ৭৬ টাকা থেকে ৮০ টাকায়।
রসুনের দাম প্রতিকেজি ৫ টাকা কমেছে। চীনের রসুন গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকায়। প্রতিকেজি ১৫ টাকা কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়।
পেঁয়াজ-রসুন-আদা আমদানিকারক খাতুনগঞ্জের মেসার্স হাজী অছি উদ্দিন সওদাগরের মালিক মো.রহুল আমিন চৌধুরী রিগ্যান সারাবাংলাকে বলেন, পেঁয়াজের দাম ঠিক আছে। রসুনের কমেছে। আদার দাম একটু বেড়েছে। তবে জাহাজ এসেছে। কয়েকদিনের মধ্যে নতুন আদা বাজারে আসবে। আদার দামও কমে যাবে।
সারাবাংলা/আরডি/জেএএম