কোটিপতি-ফকির নেই ভেদাভেদ, একপাতে খেল ৭০ হাজার মানুষ
২৬ জানুয়ারি ২০১৯ ১৭:৩২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঠিক কতবছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই মেজবানের আয়োজন চলে আসছে, তার সঠিক হিসেব নেই আয়োজকদের কাছেও। কেউ বলেন ৭০ বছর, কারও মতে তার চেয়েও বেশি। প্রয়াত পূর্বসুরীদের জন্য দোয়া কামনায় বংশ পরম্পরায় প্রতিবছর ধরে ঘটা করে চলে আসছে এই আয়োজন।
শতাধিক তামার ডেকচিতে রাত-দিন চলে রান্না। এলাকার তো আছেই, দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ স্রোতের মতো আসে-যায়। শুধু নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায় নয়, সব সম্প্রদায়ের মানুষের আনাগোণা দেখে মনে হবে যেন চলছে মানুষের মিলনমেলা! আর এই মিলন মেলায় যোগ দিতে ধনী-গরিব, কোটিপতি-রাস্তার ভিক্ষুক, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের বিপুল আগ্রহ।
প্রতিবছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই মেজবানের আয়োজন করা হয় নগরীর ৩৮ নম্বর দক্ষিণ-মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডের ওয়াসিল চৌধুরী পাড়ার ‘ওয়াসিল চৌধুরী বাড়িতে’। গত ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি দুইদিন ধরে চলা এই বিশেষ ভোজে অংশ নিয়েছেন প্রায় ৭০ হাজার মানুষ, এমন তথ্য দিয়েছেন আয়োজক ওয়াসিল চৌধুরী বাড়ির বাসিন্দারা।
আয়োজকদের একজন ওয়াসিল চৌধুরী বাড়ির বাসিন্দা প্রয়াত হাসান আহমদ চৌধুরীর ছোট ছেলে পরিবহন ব্যবসায়ী মোরশেদ আলম চৌধুরী তাজু। তারা চার ভাই মিলে ১৯৯৪ সাল থেকে মেজবানের আয়োজন করে আসছেন। দুই ভাই মারা গেছেন। জীবিত দুই ভাই মিলে এখন মেজবানের আয়োজন করেন, যার পরিসর দিন দিন বাড়ছে বলে জানালেন তাজু।
মোরশেদ আলম চৌধুরী তাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যখন খুব ছোট তখন আমার আব্বা মারা গেছেন। ছোটবেলা থেকে আমার চাচা-জ্যেঠাদের মেজবানের আয়োজন করতে দেখেছি। আমার আম্মা মারা গেছেন ১৯৯৬ সালে। আম্মা আমাদের বলেছিলেন- তোমরা যখন টাকা কামাই করবা, তখন তোমরাও মেজবান আয়োজন করবা। এটা আমাদের পরিবারের রীতি। আমাদের বাপ-দাদারা করে গেছেন। এখন আমরা করছি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আশা করি এই ঐতিহ্য ধরে রাখবে।’
অভিন্ন মেন্যুতে বিপুল মানুষের জন্য বহুমাত্রিক ভোজের আয়োজনকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় ‘মেজবান’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। চট্টগ্রামে অবশ্য এই অনুষ্ঠানকে ‘মেজ্জান’ বলা হয়। তবে এর আদত ফারসি শব্দ ‘মেজবান’। প্রচলিত আছে, প্রাচীন আমলে রাজা-বাদশাহ-জমিদাররা নিজ নিজ রাজ্য বা এলাকায় শুকনো-খরা মৌসুমে অনাহার থেকে প্রজাদের বাঁচাতে এই বিশেষ ভোজ অর্থাৎ মেজবানের আয়োজন করতেন। তবে কালের পরিক্রমায় আয়োজনে ভিন্নতা এসেছে।
এখন সাধারণত কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর আকিকা, ধর্মীয় ব্যক্তির মৃত্যুবার্ষিকী অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান এমনকি বিয়ে-পরীক্ষায় পাসের মতো শুভ অনুষ্ঠানেও আজকাল মেজবানের আয়োজন করা হচ্ছে।
রীতি অনুযায়ী মেজবানের মেন্যু হচ্ছে- সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের হাড়ের নলার ঝোল এবং বুটের ডাল। তবে দিনে দিনে এই রীতিতেও পরিবর্তন আসছে। এখন এসব খাবারের সঙ্গে মুরগির মাংস, মাছও পরিবেশন করা হয়।
ওয়াসিল চৌধুরীর বাড়িতেও আয়োজনের মধ্যে ছিল- মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য সাদা ভাত, গরুর মাংস ও গরুর পায়ের হাড়ের নলার ঝোল। অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য ছিল খাসির মাংস ও মুরগির মাংস। এছাড়া স্থানীয় সিইপিজেড এলাকায় কর্মরত বিদেশি অতিথি এবং চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনদের জন্য ছিল আরও বড় পরিসরের আয়োজন। এ ধরনের প্রায় এক হাজার অতিথির জন্য ছিল- রূপচাঁদা, গলদা চিংড়ি ও কোরাল মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, গরুর নলার ঝোল, মুরগির মাংস এবং বুটের ডাল।
মোরশেদ আলম চৌধুরী তাজু সারাবাংলাকে জানান, মেজবানের প্রথমদিন ২৩ জানুয়ারি মূলত নারীদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এলাকার পুরুষরাও খেয়েছেন। দুপুর ও রাত মিলে ৩০ হাজার মানুষকে খাওয়ানো হয়। ২৪ জানুয়ারি নারী-পুরুষ সবার জন্য ছিল। দুপুরে ১০ হাজার এবং রাতে খেয়েছে ৩০ হাজার। সব মিলিয়ে দুইদিনে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের আয়োজন ছিল।
এবছর ২৫টি গরু এবং ৬০টি খাসি জবাই করা হয়। দেড় হাজার মুরগি জবাই করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাজু।
বাবুর্চি মো.জাকির সারাবাংলাকে জানান, দুইদিন ধরে ১২০টি তামার ডেকচিতে রান্না হয়েছে। ২২ জানুয়ারি রাত ১টা থেকে রান্না শুরু হয়। ২৪ জানুয়ারি রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত রান্না হয়েছে। মূল বাবুর্চির সঙ্গে সহযোগী ছিল আরও কমপক্ষে ৫০ জনের একটি টিম। এছাড়া খাবার পরিবেশনসহ আনুষাঙ্গিক কাজে যুক্ত ছিল আরও কমপক্ষে ৫০০ লোক।
‘ওয়াসিল চৌধুরী বাড়ির’ পাশে খোলা মাঠে আয়োজিত এই মেজবানে নগরীর পতেঙ্গা, কাট্টলী, ইপিজেড এলাকা, হালিশহর থেকে সাধারণ মানুষ যোগ দেন। চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধি, উর্দ্ধতন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও প্রতিবছরের মতো এবার অংশ নিয়েছেন মেজবানে। নেই ধনী-গরিবের ভেদাভেদ, সবাই একপাতে বসে খেয়েছেন।
‘১৯৯৪ সালে যখন আমরা শুরু করি, মাত্র ৭টি গরু জবাই করেছিলাম। খেয়েছিল ১২ হাজার মানুষ। দিনে-দিনে পরিসর বড় হচ্ছে। এখন আর সেভাবে কাউকে দাওয়াতও করতে হয় না। আমাদের বাড়ির মেজবানের খবর এলাকার মানুষের জানা থাকে। আগামী বছর হয়ত লোক প্রায় লাখের কাছাকাছি হবে। অথবা এর চেয়েও বেশি হতে পারে। আল্লাহ যতদিন তওফিক দিয়েছেন, ততদিন আমাদের পূর্বপুরুষ, মুরব্বীদের দোয়ার জন্য এই মেজবানের আয়োজন আমাদের পরিবার করে যাবে’ বলেন তাজু
মেজবানে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা প্রায় ৭০ বছর বয়সী মো.কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বয়সে আমি সবসময়, প্রতিবছর এখানে মেজবানের আয়োজন দেখেছি। আমি অনেকবছর ধরে আসছি। আমার মতো হাজার হাজার মানুষ আসেন।’
মেজবানে অংশ নেওয়া অভিজাত মিষ্টিবিপণী হাইওয়ে সুইটস’র স্বত্তাধিকারী মো.মুরাদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘লাখপতি-কোটিপতি বড়লোক মানুষ, আবার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ, গরীব-ভিখারি পর্যন্ত সব মানুষ একসঙ্গে বসে খাচ্ছে, এটা দেখলেও ভালো লাগে। কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। এই ধরনের আয়োজন আরও হলে মানুষে-মানুষে বৈষম্য থাকে না। একইভাবে ধনী মানুষদের সবার উচিৎ অন্তত বছরে একবার হলেও এই ধরনের মেজবানের আয়োজন করা।’
সারাবাংলা/আরডি/একে