যানজটের মূলে রিকশা-লেগুনা, প্রভাব ফেলছে মেট্রোরেলও
২৮ জানুয়ারি ২০১৯ ২০:৪৮
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ফের চলছে ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ। এর আগে সপ্তাহ ও মাসব্যাপী এই শৃঙ্খলা কার্যক্রম চালিয়েও তেমন সুফল মেলেনি। এবারেও ট্রাফিক পক্ষ চলাকালীনও যানজট পিছু ছাড়ছে না নগরবাসীর। পুলিশ বলছে, নগরীর এই ভয়াবহ যানজটের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে সড়কের লেনগুলোতে লাগামহীনভাবে রিকশা আর লেগুনার চলাচল। এর সঙ্গে যত্রতত্র পার্কিংয়ের কারণে অনেক স্থানেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে যানচলাচলের স্থান। পাশাপাশি মেগা প্রজেক্ট মেট্রোরেলের কাজও প্রভাব ফেলছে যানজটে।
নগরবাসী বলছেন, দিন যত যাচ্ছে, যানজট ততই যেন লাগামছাড়া হয়ে পড়ছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে ৯টার অফিস ধরনে দুই-আড়াই ঘণ্টা আগে বেরিয়েও সময়মতো পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।
রোববার (২৭ জানুয়ারি) রাজধানীর বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে দেখা যায়, কোথাও গাড়ি থমকে আছে আবার কোথাও ছুটছে। ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বাড়তি জনবল মাঠে কাজ করেও যানজট কমাতে পারছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, যত্রতত্র পার্কিং, লাগামহীন লেগুনা আর রিকশার দৌরাত্ম্যে একাকার হয়ে গেছে যাত্রাবাড়ী এলাকা। কেউ কাউকে মানছে না, নেই লেন মানার বালাই, যে যার মতো গাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কর্তব্যরত পুলিশও যেন অসহায়।
তবে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর আব্দুল গণি রোড ও বাংলামোটর এলাকায়। এর মধ্যে আব্দুল গণি রোডের উভয় পাশ থেকে কোনো রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়নি। এখানে আনসার সদস্যরা রয়েছেন সার্বক্ষণিক পাহারায়। বাংলামোটরেও দেখা যায়, নিউ ইস্কাটন রোডের জনকণ্ঠ ভবনের সামনে থেকে আর পশ্চিম দিকে কোনো রিকশা যেতে পারছে না। পুলিশ সদস্যরা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। তেমনিভাবে সময় টেলিভিশনের সামনে থেকে বাংলামোটর ক্রসিংয়ের যে সড়ক, সেখান দিয়েও রিকশা যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। যদিও একটা সময় বাংলামোটর-নিউ ইস্কাটন সড়কটি ছিল রিকশারই দখলে, যানজটেও ভুগতে হতো এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারীদের।
ট্রাফিক সার্জেন্ট আতাউস সানি ছিলেন এই সড়কে কর্তব্যরত। জানতে চাইলেই বললেন, ‘এখন তো আর রিকশা চলে না এই রাস্তায়। দেখেন তেমন কোনো যানজটই নেই।’
একটু এগিয়ে কারওয়ান বাজার সিগন্যালে যেতেই দেখা যায়, আশপাশের প্রায় সবগুলো সড়কেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি। পশ্চিমে বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স পেরিয়ে গেছে এসব যানবাহন। বিপরীত পাশে বসুন্ধরা সিটির আগে থেকেই যানবাহনের সারি গিয়ে ঠেকেছে পান্থপথ সিগন্যালে।
বসুন্ধরা সিটির সামনে কথা হয় পথচারী আনজির মামুনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ রাতারাতি সম্ভব নয়। আমাদের রাস্তাগুলো পরিকল্পিত নয়। একই সড়কে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, রিকশা, ভ্যান, সিএনজি, লেগুনা— সবই চলে। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার অনেকেই ১০ টাকা ৫ টাকা খেয়ে এসব যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছেন। এমনকি মালবাহী অনেক ভ্যানও মাঝে মধ্যেই দেখা যায় মূল সড়কে। এসব বন্ধ না করতে পারলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয়।
কারওয়ান বাজার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাস। বাসের চালক আব্দুল্লাহ নয়ন বলেন, রাস্তায় বাস চালানোর সময় হঠাৎ হঠাৎ সামনে রিকশা চলে আসে। এর চেয়ে বিরক্তির আর কিছু হতে পারে না। বাসের সঙ্গে পাশাপাশি রিকশা চলাটা রিস্কেরও খুব। এরা তো ডানে-বায়ে তাকায় না। আর আমরা সাধারণ স্পিডে গাড়ি চালালেও কোনো রিকশায় সামান্য ধাক্কা লাগলেই সেটা দুমড়ে-মুচড়ে যাবে। সেটা ওদের ভুলের কারণেই হয়, মাঝখান থেকে দোষ হয় আমাদের। ওদের বাঁচাতে আমাদেরই বেশি সতর্ক থাকতে হয়। এ কারণে মূল সড়কে রিকশা বন্ধ রাখার দাবি জানান তিনি।
মূল সড়কে রিকশা কেন— জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম সারাবাংলাকে বলেন, মূল সড়কে যেন রিকশা চলতে না পারে, সেজন্য রিকশা ধরতে ডিএমপির একটি রিকশা পার্টি করে দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে আনসার সদস্যরা কাজ করে থাকেন। বিষয়টি আরও তদারকি করা হবে বলে জানান তিনি।
মেট্রোরেলের অবকাঠামোর কাজ চলমান থাকার কারণেও বিভিন্ন পয়েন্টে যানজট তৈরি হচ্ছে বলে জানান যাত্রী-চালকরা। যদিও এ ধরনের মেগাপ্রজেক্টের জন্য এটুকু ভোগান্তিকে মেনে নিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি অভিযোগ করে বলছেন, যেসব পয়েন্টে মেট্রোরেলের কাজ চলছে, সেসব পয়েন্টেও যদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করা যায়, তাহলে মেট্রোরেলের কাজও এতটা প্রভাব ফেলবে না। সে কারণে তারা রিকশা-লেগুনা নিয়ন্ত্রণসহ লেন মেনে যানচলাচলে গুরুত্ব দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এর পাশাপাশি রাজধানীজুড়েই বিভিন্ন স্থানে রাস্তার একটি বড় অংশই প্রাইভেট কারের দখলে থাকতে দেখা যায়। বিশেষ করে কোনো শপিং মল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে এভাবে সড়ক দখলের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। যদিও পুলিশ বলছে, সড়কে পার্কিংয়ের প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পরিমাণে কমলেও যত্রতত্র পার্কিংয়ের ফলে ভোগান্তি খুব একটা কমেনি।
মগবাজার মোড়ে কথা হয় বেসরকারি একটি ব্যাংকে মো. শহিদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের কাজই বলেন আর রাস্তার খোঁড়াখুড়িই বলেন, এগুলো তো সারা বছর লেগেই থাকে। কিন্তু এসব মাথায় রেখেই যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই সড়কে চলাচল করে, তাহলে যানজট থাকলেও তা সহনীয় মাত্রায় থাকবে। আমরা যারা ঢাকায় থাকি, আমরা কল্পনাও করি না যে ঢাকা শহরে যানজট থাকবে না। আমাদের চাহিদা এতটুকুই যেন যানজট কিছুটা সহনীয় মাত্রায় থাকে।
যাত্রী কল্যাণ সমিতিরি মহাসচিব মোজাম্মেল হক সারাবাংলাকে বলেন, যাত্রাপথে রাস্তার পাশে আলাদা জায়গাজুড়ে বাস স্টপেজ তৈরি করতে হবে। এখন রাস্তায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। সিগন্যালের সংখ্যা কমাতে হবে, প্রয়োজনে একটু ঘুরে আসবে গাড়ি, লেনভিত্তিক গাড়ি চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানি চুক্তিতে গাড়ি চালিয়ে থাকে। আমরা এর বিরোধিতা করে আসছি। কিন্তু কেউ মানছে না। এ কারণে সড়কে বিশৃঙ্খলাও কমছে না কোনোভাবেই।
এদিকে, ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, রাজধানীতে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার মামলা হয়েছে। এর বিপরীতে দুই কোটিরও বেশি টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। উল্টো পথে গাড়ি চালানো, হাইড্রলিক হর্নের ব্যবহার, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার করা, মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস লাগানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা ও গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অপরাধে এসব মামলা হয়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এখন চালক, যাত্রীসহ সবাই এগিয়ে এলেই ট্রাফিক কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর