ব্রেক্সিট: পার্লামেন্টে বিশৃঙ্খল বিতর্ক, ভোটের অপেক্ষায় ব্রিটেন
২৯ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:৪০
।। আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ বা ‘ব্রেক্সিট’ কার্যকর হতে বাকি আর মাত্র দু’মাস। কিন্তু এখনও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো চুক্তি চূড়ান্ত হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে’র প্রস্তাবিত চুক্তি ব্যাপক ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। পরপরই বিরোধী দল লেবার প্রস্তাবিত এক অনাস্থা ভোটে অল্প ব্যবধানে টিকে যান মে। সবমিলিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। দেখা দিয়েছে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের আশঙ্কা। এমতাবস্থায় নিজের অবস্থান পাল্টেছেন মে।
মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীর প্রস্তাবের ওপর ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে বিতর্ক। উল্লেখ্য, এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হাউজ অব কমন্সে বিতর্ক চলছে।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় (বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ১টা) ব্রেক্সিট চুক্তির সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের ওপর ভিত্তি করে ব্রেক্সিটের নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন মে। নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন তিনি। ভোটের আগে স্থানীয় সময় দুপুর ১টা (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা) থেকে বিতর্ক চলছে।
ব্যাকস্টপ নিয়ে ইইউ’র সঙ্গে ফের আলোচনা হবে: মে
মে তার বক্তব্যে বলেছেন, তিনি ইইউ’র সঙ্গে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ব্যাকস্টপ পরিকল্পনা নিয়ে পুনরায় আলোচনার চেষ্টা চালাবেন। বিতর্কিত ব্যাকস্টপ পরিকল্পনা নিয়ে ফের আলোচনা করতে ব্রাসেলস যাবেন।
তবে ইইউ জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ক চুক্তি পাল্টাবে না। এ প্রসঙ্গ টেনে মে বলেন, ইইউ অনিচ্ছুক থাকলেও তিনি নিশ্চিত যে, তিনি এ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে পারবেন।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মঙ্গলবার ব্রেক্সিট চুক্তির সংশোধনী নিয়ে অনুষ্ঠেয় ভোট ইইউ’র কাছে ব্যাকস্টপ নিয়ে একটি পরিষ্কার বার্তা পাঠাবে।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে দেওয়া নিজের বক্তব্যের শুরুতে মে বলেন, এই কক্ষে এমন কেউ নেই যিনি নিশ্চিত নন যে তিনি কী চান। আজ আমাদের উচিত আমরা কী চাই, সে বিষয়ে একটি জোরালো বার্তা পাঠানো।
তিনি আরও বলেন, সময় এসেছে আমাদের কথাকে কাজের সঙ্গে মেলানোর। আপনি যদি ব্রাসেলসকে জানাতে চান এই কক্ষ কী মেনে নেবে, তাহলে আপনাকে সেজন্য ভোট দিতে হবে। আপনি যদি চুক্তিসহ বের হয়ে আসতে চান, তাহলে আপনাকে ভোট দিতে হবে। আপনি যদি ব্রেক্সিট চান তাহলে আপনাকে ভোট দিতে হবে।
নিজের চুক্তির প্রতি মন্ত্রীদের অনীহার প্রসঙ্গ টেনে মে বলেন, আমি জানি এই কক্ষ আমার প্রস্তাবিত চুক্তিটিকে এর বর্তমান অবস্থায় চায় না। পুরো বিশ্ব জানে এই কক্ষ তা চায় না।
আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করা অপরিহার্য: করবিন
বিরোধী দলীয় নেতা জেরেমি করবিন তার বক্তব্যের শুরুতেই আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন। বলেন, অনুষ্ঠেয় ভোটে যাই হোক না কেন, এটা এখন নিশ্চিত যে, সরকারকে যেকোনো পরিস্থিতিতে আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন থেকে ২৯ মার্চের মধ্যে সকল প্রয়োজনীয় আইন পাস হওয়ার কোন নিশ্চিত সম্ভাবনা ছিল না। এরপরই করবিন হস্তক্ষেপের শিকার হন।
হস্তক্ষেপ আহ্বান নিয়ে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা শেষে করবিন পুনরায় বক্তব্যে ফিরে আসেন। ফিরে এসে বলেন, কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের দৃষ্টিভঙ্গি মানতে চাইছে না সরকার।
লেবার নেতা বলেন, এই সরকারের ব্রেক্সিট আলোচনার বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা দ্রুত গতিতে সংকটে পরিণত হচ্ছে, এটা উদ্বেগজনক। এতে কর্মজীবী মানুষের মধ্যে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। আর সবাই উদ্বিগ্ন যে, এই সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো নেতৃত্ব নেই। এমন একটি সরকার থেকে কোনো নেতৃত্ব নেই যেটি এখন পর্যন্ত কোনো ভালো চুক্তির আলোচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে, যে সরকার পার্লামেন্টের ভাষ্য শুনতে ইচ্ছুক না। যার কারণে আমরা পার্লামেন্টের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয় সত্ত্বেও আবার এখানে হাজির হয়েছি।
যেসব সংশোধনীর ওপর ভোট ও আলোচনা
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তির মোট সাতটি সংশোধনীর প্রস্তাব নিয়ে যুক্তি প্রদর্শন ও ভোটদানের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবগুলো হলো—
অ্যামেন্ডমেন্ট এ: এই প্রস্তাব রেখেছেন জেরেমি করবিন। তিনি প্রস্তাব করেছেন, চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের সম্ভাবনা দূর করতে ও ইইউ’র সঙ্গে যুক্তরাজ্যের একটি স্থায়ী কাস্টমস ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে।
অ্যামেন্ডমেন্ট ও: এই প্রস্তাব রেখেছেন স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) মন্ত্রী ইয়ান ব্ল্যাকফোর্ড। তার প্রস্তাবে তিনি আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করতে প্রস্তাব দিয়েছেন। এই প্রস্তাবকে বলা হয়েছে স্টপ দ্য ক্লক সংশোধনী। উল্লেখ্য, আর্টিকেল ৫০ এর হাত ধরেই ব্রেক্সিট কার্যকরের দিন তারিখ নির্ধারিত হয়েছে।
অ্যামেন্ডমেন্ট জি: কনজারভেটিভ মন্ত্রী ডমিনিক গ্রিয়েভের এই সংশোধনী প্রস্তাব অনুসারে, ব্রেক্সিটের নিয়ন্ত্রণ পার্লামেন্টের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এর বদলে মে’র চুক্তির একাধিক বিকল্পের ওপর ভোট হবে।
অ্যামেন্ডমেন্ট বি: লেবার এমপি ইয়েভিট্টি কুপার, আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অ্যামেন্ডমেন্ট জে: ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কোনো চুক্তিতে না পৌঁছানো গেলে আর্টিকেল ৫০ বর্ধিত করার প্রস্তাব রেখেছেন র্যাচেল রিভস।
অ্যামেন্ডমেন্ট আই: চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের অপশন বাতিল করার প্রস্তাব রেখেছেন ড্যাম ক্যারোলিন স্পেলম্যান।
অ্যামেন্ডমেন্ট এন: মে’র চুক্তি থেকে নর্দার্ন আইরিশ ব্যাকস্টপ বাতিল করে ওই চুক্তি নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন স্যার গ্রাহাম ব্র্যাডি।
বিশৃঙ্খল আবহাওয়া
ব্রেক্সিট নিয়ে বিতর্কে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিশৃঙ্খল আবহাওয়া বিরাজ করছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পার্লামেন্ট স্পিকার জন বেরকো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনের বক্তব্য দেওয়ার সময় পার্লামেন্টে তীব্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
উল্লেখ্য, কোনো মন্ত্রীর বক্তব্যে অন্যান্য মন্ত্রীরা চাইলে হস্তক্ষেপের অনুরোধ করতে পারেন। এক্ষেত্রে বক্তা ওই হস্তক্ষেপ গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। আরেকটি উপায় হচ্ছে, পার্লামেন্টারি প্রক্রিয়া নিয়ে স্পিকারের কাছে ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ ডেকে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
মঙ্গলবার পার্লামেন্টে করবিন ও মে’র বক্তব্যের সময় অসংখ্য হস্তক্ষেপের অনুরোধ ও পয়েন্ট অফ অর্ডারের ডাক পড়েছে। বিশেষ করে করবিন তার বক্তব্যের সময় নিজ দলের সদস্য এঞ্জেলা স্মিথের একটি হস্তক্ষেপ অনুরোধ না বারবার প্রত্যাখ্যান করে গেলে তা নিয়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একইরকম ঘটনা দেখা গেছে মে’র ক্ষেত্রেও।
(সিএনএন, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি অবলম্বনে)
সারাবাংলা/ আরএ