Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিপুল বীজ অবিক্রিত, ফের সমালোচনায় বিএডিসি


৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:১০

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: স্বল্প মূল্যে সরকারিভাবে কৃষকের কাছে উন্নত মানের বীজ সরবরাহ করে থাকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। প্রতি বছরই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বীজ নিয়ে নানা গাফিলতির অভিযোগ উঠে। কখনও সরবরাহ ঘাটতি কিংবা কখনও বাড়তি উৎপাদন। এবারও চলতি রবি মৌসুমে বোরো ধানের বীজসহ বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থেকে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির কড়া সমালোচনা করেছেন এক সংসদ সদস্য। বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থাকার বিষয়টি আলোচনায় আসে ওই সাংসদের বক্তব্য ধরেই।

বিজ্ঞাপন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি রবি মৌসুমে বিএডিসির ৪৩ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বীজ অবিক্রিত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বিপুল পরিমাণ এই বীজ অবিক্রিত থাকায় সরকারের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব নাসিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বীজ অবিক্রিত থাকার ক্ষেত্রে গাফিলতি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। বাজারে বীজের চাহিদা একেক সময় একেক রকম হয়ে থাকে। চাহিদা সব সময় উঠানামা করে। কোন কোন সময় কৃষকরা নিজেদের সংগ্রহ করা বীজ দিয়েই ফসল ফলিয়ে থাকে। আবার কখনও এক ফসল থেকে অন্য শষ্যে স্থানান্তরিত হয়। ফলে কোন বছরে বীজ অবিক্রিত থাকতেই পারে।’

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে নাসিরুজ্জামান আরও বলেন, ‘যদি বীজ অবিক্রিত থাকে তবে তা নিষ্পত্তি করবে বিএডিসির বোর্ড। বোর্ডের সদস্যরা বসেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করবেন।’

বীজ অবিক্রিত থাকার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান ফজলে ওয়াহেদ খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বীজ বিক্রি হবে আবার অবিক্রিতও থাকবে, এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। এটাকে সেই অর্থে নেতিবাচকভাবে দেখার উপায় নেই। আমাদের কাজ বীজ দিয়ে কৃষককে সহায়তা করা, বীজের বাজারকে স্থিতিশীল রাখা, বাজারে বিএডিসির ভিন্নমাত্রার ভূমিকা রয়েছে। তবে এবছর বীজ একটু বেশি অবিক্রিত থেকে গেছে।’

বিজ্ঞাপন

বিএডিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এ বছর বোরো মৌসুমের আটাশ ধানের বীজ কম বিক্রি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত বছর বোরো ধানের এই জাতটিতে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বীজ অবিক্রিত থাকার ক্ষেত্রে এটিও একটি কারণ হতে পারে। এছাড়া আটাশ ও উনত্রিশের মতো পুরোনো জাতের বীজের প্রতি কৃষকের চাহিদাও কমছে।’

বীজ বিক্রির ক্ষেত্রে বিএডিসির কর্মকর্তাদের গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে এমন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএডিসি চেয়াম্যান আরও বলেন, ‘বীজ অবিক্রিত থাকা এটি কোন অভিযোগের বিষয় নয়। বিষয়টিকে সিঙ্গল ডায়মেনশনে দেখলে হবে না। বিএডিসির কাজ বহুমুখি। কৃষকের কথা চিন্তা করেই বাজারে আমাদের বেশি বীজের সরবরাহ রাখতে হয়।’

জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মজুত বীজের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে আউশ, আমন ও বোরোসহ রবি এবং শীত মৌসুমের বিভিন্ন ফসলের বীজ রয়েছে। এসব উচ্চ ফলনশীল বীজ বিএডিসি কর্তৃক দেশের ২২টি অঞ্চলের ৮ হাজার ৫৩৬ ডিলার এবং ১০০টি বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্তু চলতি বছরের রবি মৌসুমে অবিক্রিত বীজের পরিমাণ ৪৩ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি। সমপরিমাণ এই বীজের অর্থমূল্য ১৭০ কোটি টাকার বেশি। চলতি বোরো মৌসুমে বীজ বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৪ হাজার ১৪৭ দশমিক ৮১২ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ২৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বীজ অবিক্রিত থেকে গেছে। আর সমপরিমাণ এই বীজের অর্থমূল্য ১১০ কোটি টাকারও বেশি।

এছাড়াও অবিক্রিত রয়েছে গম বীজ ১০ হাজার ৩৯৮ শমিক ৬৮৩ মেটিক টন, ভুট্টাবীজ (খৈ ভুট্টা) ৫ দশমিক শূন্য ২০ মেট্রিক টন, ভুট্টাবীজ (হাইব্রিড) ৬ দশমিক ৩১০ মেট্রিক টন, আলুবীজ ৫ হাজার ৮০ দশমিক ৬৮৩ মেট্রিক টন, ডালবীজ ৪৭০ দশমিক ৮০৫ মেট্রিক টন, তৈলবীজ ৩১ দশমিক ৭৩০ মেট্রিক টন, শীতকালীন সবজিবীজ ১৭ দশমিক ২৬২ মেট্রিক টন, মসলা (পেঁয়াজবীজ) ১ দশমিক ১০৬ মেটিক টন, মসলা (পেঁয়াজ বাল্ব) ৯৩ দশমিক শূন্য ৪০ মেট্রিক টন, গ্রীষ্মকালীন সবজিবীজ ২৪ দশমিক ৯৯৪ মেট্রিক টন এবং সরগম ৪ দশমিক ১৫৬ মেট্রিক টন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৪৩ হাজার মেট্রিক টন বীজের আনুমানিক মূল্য ১৭০ কোটি টাকারও বেশি। তবে উচ্চফলনশীল এসব বীজ অবীজ হিসেবে বিক্রি করা যাবে ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকায়। এতেও সরকারের ক্ষতি ১১০ কোটি টাকার বেশি। এদিকে, বিপুল পরিমাণ এই বীজ অবিক্রিত থাকায় খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তারা বলছেন, ৪৩ হাজার মেট্রিক টন বীজ অবিক্রিত থাকায় মৌসুমটিতে ফসলের উৎপাদন কমে যাবে ৯ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। আর এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

সম্প্রতি জাতীয় সবজি মেলার এক অনুষ্ঠানে বিএডিসির বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংসদ সদস্য কৃষিবিদ আবদুল মান্নান। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। জানতে চাইলে এমপি আবদুল মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বীজ অবিক্রিত থাকার বিষয়টি আমি বিএডিসির মাধ্যমেই জেনেছে। বিষয়টি তারাও স্বীকার করেছে। সবচেয়ে বেশি অবিক্রিত আছে বোরো মৌসুমের আটাশ ধানের বীজ। এ বিষয়ে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।’

সংশ্লিষ্ট ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণ বীজ উৎপাদনের কারণে চলতি মৌসুমে বীজ অবিক্রিত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মূল অদক্ষতা বিএডিসির। তবে আমন মৌসুমে বাম্পার ফলন এবং ধানের দাম না পাওয়ার কারণেও আবাদী জমির পরিমাণ কমে যেতে পারে। আবার সরকারি বীজের চেয়ে বেসরকারি বীজের প্রতি আকর্ষণ বা চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেও কমতে পারে বিএডিসির বিক্রির পরিমাণ।

মন্তব্য জানতে চাই কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএডিসি তো আগের বিএডিসি নেই। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও অন্ত নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচিৎ গাফিলতির বিষয়টি তদন্ত করে দেখা। তবে এমনও হতে কৃষক ধান উৎপাদন থেকে সরে গেছে। কারণ আমন মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে, কিন্তু কৃষক দাম পায়নি। সেই অর্থে কৃষকের জন্যে তো অর্থনৈতিক প্রণোদনা নেই।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বীজ উৎপাদনে বিএডিসির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ভুল থাকার কারণে বিপুল পরিমাণ বীজ অবিক্রিত থাকতে পারে। দাম ও উচ্চফলনশীলতার কারণে হয়তো প্রাইভেট কোম্পানির বীজগুলোর সঙ্গে বাজারে পাল্লা দিতে পারছে না সরকারি বীজ। কিংবা কৃষক অন্য ফসলে চলে যাওয়ার কারণেও বীজ অবিক্রিত থাকতে পারে।’

এদিকে, চলতি বোরো মৌসুমের বীজতলা তৈরির কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বোরো ধান রোপনের প্রস্তুতি চলছে। রবি মৌসুমের অন্যান্য ফসলের আবাদ কাজও শুরু বা শেষ পর্যায়ে। ফলে অবিক্রিত থাকা বীজ দিয়ে আর চাষাবাদের সুযোগ নেই। ফলে অবিক্রিত বীজের আর্থিক ক্ষতিসহ উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সারাবাংলা/ইএইচটি/এমএইচ

কৃষি কৃষি মন্ত্রণালয় বিএডিসি বীজ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর