সোনালি আঁশের সুদিন ফেরাবে সোনালি ব্যাগ
৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:৩৩
।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।
ঢাকা: শীতলক্ষ্যার তীর। শান্ত নদীতে কদাচিৎ চোখে পড়ে দুয়েকটি বালুবাহী ট্রলার। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের এই তীর একসময় মুখর থাকত পাটবাহী জাহাজের উপস্থিতিতে। পাটের মৌসুম হোক বা না হোক, পাটকলগুলো থেকে পাটজাত পণ্য এই নদী ধরেই যেত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পাটের সেই সুদিন গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ততা কমেছে শীতলক্ষ্যাতেও।
অথচ এককালে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল ছিল পাট। রফতানি আয়েরও সবচেয়ে বড় উৎস ছিল এটি, যে কারণে একে বলা হতো সোনালি আঁশ। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসও জড়িয়ে আছে এই সোনালি আঁশের সঙ্গে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের রক্ত জল করা পরিশ্রমে উপার্জিত সোনালি আঁশ থেকে যে রফতানি আয়, তা চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৬৬’র ছয় দফায় উঠে এলো এই প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে। অর্থাৎ আমাদের পাটের আয় আমাদেরই থাকতে হবে।
কিন্তু পাটের এই শৌর্যের সূর্য অস্তগামী হয় ক্রমশই। একাত্তরে দেশ স্বাধীনের আগেই পলিথিন চলে এসেছে বাজারে। সেই পলিথিন দখল করে নিতে থাকে পাটের ব্যাগের বাজার। কমতে কমতে একসময় বন্ধই হয়ে যায় পাটের ব্যবহার। ২০০২ সালে আদমজী পাটকল আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হওয়ার পর শীতলক্ষ্যা পড়ে কর্মব্যস্ততাহীন এক নদী। এরপর পাট শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে বহুবার বহু রকমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু শীতলক্ষ্যার জলে আর ওঠেনি আলোড়ন।
প্রায় দুই দশকের বিরতির পর সোনালি দিন হারিয়ে ফেলা সোনালি আঁশকে নিয়ে আবার আশার আলো দেখালেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। তিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর পাটের সেই গৌরব ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সোনালি ব্যাগের হাত ধরে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানী মোবারক আহমেদ খান পথ দেখিয়েছেন সোনালি ব্যাগের। যে পলিথিনের কবলে পড়ে ছিটকে পড়েছিল পাট, তেমন পলিথিনই এবার পাট থেকে তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন এই বিজ্ঞানী। এই পলিথিন হবে পচনশীল, ফলে পরিবেশবান্ধবও। ‘সোনালি ব্যাগ’ নামের এই পলিথিন বাজার দখলে নিতে পারলে পাটের সোনালি দিনে ফেরাটা কেবল সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুটমিল। মিলের একদম একপ্রান্তে ছোট একটা কারখানা। কারখানা না বলে ওয়ার্কশপ বলাই ভালো। সেখানে দেশীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব ছোট পরিসরে তৈরি হচ্ছে পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ। তবে এই সোনালি ব্যাগের কাঁচামাল পাট নয়, পাটজাত পণ্যের ফেলে দেওয়া এক অংশ— ক্যাডিস।
বিজ্ঞানী মোবারক হোসেন তার ক্ষুদ্র কর্মী বাহিনী নিয়ে এখানে কাজ করছেন। উৎপাদনের পরিমাণ সামান্য হলেও কাজের পরিধিটা নেহায়েত ক্ষুদ্র নয়। প্রথমে ফেলে দেওয়া ক্যাডিস জোগাড় করেন তারা। বিষয়টি অবশ্য খুব কঠিন নয়। পাট প্রক্রিয়াজাতের পর এমনিতেই এই কাডিস বের হয়। তা ঢিবি করে ফেলে রাখা হয় অবহেলায়, পরে একসময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় খোলা বাতাসেই।
এতদিন যে ক্যাডিস পুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি হতো, সেই ক্যাডিস থেকেই পাটের পলিমার বের করে পলিথিন তৈরির পদ্ধতি বের করেছেন মোবারক হোসেন। এর মাধ্যমে ক্যাডিস থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন ঠেকানোরও পথ বের করে ফেলেছেন তিনি।
এই পাট বিজ্ঞানী ধাপে ধাপে তার ছোট্ট কারখানাটা ঘুরিয়ে দেখান। দেখা গেল, প্রথমে ক্যাডিসগুলোকে ব্লিচ করে সাদা করা হয়। তারপর সেটা থেকে বের করা হয় সেলুলোজ পাউডার, যেন এর দ্রবীভূত হওয়ার সক্ষমতা বাড়ানো যায়। এ থেকেই তৈরি হয় পলিমার মিশ্রণ। এই মিশ্রণকে আবার একটা প্লেটে ফেলে শুকিয়ে ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় নিয়ে তৈরি করা হয় পলিমার।
মোবারক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের এখানে যে মেশিন আছে, তাতে ৪০ মিনিটে মাত্র ৫০ ফুট সোনালি ব্যাগের পলিমার তৈরি করা যায়। এখন আমরা এমন একটি মেশিন খুঁজছি যা মিনিটে তিন হাজার ফুট পলিমার তৈরি করতে পারবে।
পলিমারের এই বাজারটা বিশাল। শুধু বাংলাদেশেই দৈনিক পাঁচশ টন পলিথিন প্রয়োজন হয়। মোবারক হোসেনের দাবি, এটা শুধুই গৃহস্থালি চাহিদা। শিল্প ক্ষেত্র তো বটেই, দৈনন্দিন কাজে আমরা যেসব পলিথিন পণ্য ব্যবহার করি, সেগুলোও এই হিসাবের বাইরে। ফলে এই পলিথিন উৎপাদন শুরু হলে আর যাই হোক, বাজার না পাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
মোবারক হোসেন বলেন, এই ব্যাগগুলো সম্পূর্ণভাবে পচনশীল। এমনকি এর স্থায়িত্বের বিষয়টিও নির্ধারণ করা যায়। অর্থাৎ কত দিনের মধ্যে এই পলিথিনকে পচনশীল করতে চাই, সেই অনুযায়ী এর স্থায়িত্ব ঠিক করে দেওয়া যায়। ব্যাগগুলোয় কোনো ধরনের প্লাস্টিক উপকরণ নেই, তাই কোনোভাবেই এটা পরিবেশের ক্ষতি করছে না। তাছাড়া এ ব্যাগ বাজারে লভ্য পলিথিনের ব্যাগের চেয়ে দেড়গুণ বেশি শক্তিশালী। আর চাহিদা অনুযায়ী এর পুরুত্বও নির্ধারণ করা সম্ভব।
মোবারক হোসেন এখন প্রতিদিন ১০ টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে ভাবছেন। তিনি বলেন, আগে আমরা দৈনিক তিন টন পলিথিন উৎপাদনের কথা ভাবছিলাম। এখন আমরা ১০ টনের কথা ভাবছি। কারণ সারাবিশ্বে প্রতি মিনিটে ২০ মিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যাবহার করা হয়, আর পরিবেশের ক্ষতি সবারই চিন্তায় আছে। তাই এটা আমাদের জন্যেও বড় একটা বাজার।
বাংলাদেশে পাট শিল্প গুটিয়ে আসছে তাও প্রায় ২০ বছর হতে চললো। এখনও কি সেই পরিমাণে পাট উৎপাদন হয় যা দিয়ে বিশাল এই বাজার ধরা সম্ভব? এমন প্রশ্ন উত্থাপন করলে সহাস্য জবাব দেন এই বিজ্ঞানী। বলেন, আমরা কিন্তু এখনও মূল পাট ধরিনি। আমরা কাজ করছি পাটের ফেলে দেওয়া একটা আঁশ থেকে। তবে বাজার যদি সত্যিই ধরতে হয়, তবে বাংলাদেশে এখনও যে পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, তা দিয়েই মেটানো যাবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ পলিথিনের চাহিদা।
মোবারক হোসেনের এই সোনালি ব্যাগের প্রকল্প দেখতে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে এসেছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি বলেন, সোনালি ব্যাগ দিয়েই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে সোনালি আঁশের স্বর্ণ যুগ। প্রয়োজনে সোনালি ব্যাগ তৈরির এই প্রক্রিয়াকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে, যেন দ্রুত এর উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
শীতলক্ষ্যার পাড়ের মানুষও চেয়ে আছে সে পথের দিকে, যখন আবারও নদী বয়ে আসবে পাট। সোনার আঁশের গন্ধে মৌতাত হবে তাদের জীবন।
সারাবাংলা/এমএ/টিআর/জেএইচ