Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অপরাধীরা শাস্তি না পাওয়ায় বাড়ছে শিশু অপহরণ-হত্যা 


৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:২৪

 ।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সম্প্রতি অপহরণের পর শিশুহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। আর অপরাধবিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। তাদের মতে, দুর্বলতার জায়গা ও সহজ পন্থা হিসেবে শিশুকেই টার্গেট করা হচ্ছে। এ কারণে তারা অভিভাবকদের নিজেদের কাজের সময় কমিয়ে শিশুসন্তানকে সময় দেওয়ার দিকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

নতুন বছরের প্রথম মাসে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, যশোর, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। এরমধ্যে সর্বশেষ গত মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) রাজধানীর লালবাগ থানা এলাকায় মাত্র ১৫০০ টাকা নিয়ে ঝগড়ার জের ধরে বন্ধু রমজান আলীর সাত বছরের শিশুপুত্র হৃদয়কে খুন করে ইয়াছিন।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীর চর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কামরাঙ্গীর চরের আলীনগর চান সাদেক মসজিদের পাশের খোলা জায়গা থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল স্যার সলিমুল্ল্যাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে হৃদয়ের লাশ শনাক্ত করেন শিশুটি মা সোমা। পরে পুলিশের কাছে হত্যার দায় কথা স্বীকার করে ইয়াছিন।’

এ ঘটনার আগে (২৮ জানুয়ারি) ঢাকার ধামরাইয়ে সোনামিয়ার পাঁচ বছরের শিশু মনির হোসেনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিন দিন আগে মনিরও অপহৃত হয়েছিল।

নিহতের স্বজনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, গত ২৬ জানুয়ারি (শনিবার) বিকেল ৫টার দিকে বাড়ির পাশে সালাম মেম্বারের ধানের চাতালে খেলতে যায় মনির। সন্ধ্যার পরও সে বাড়ি না ফিরলে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেন তারা। কোথাও না পেয়ে পরদিন রোববার ধামরাই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সোনা মিয়া। এরপর সোমবার বিকেলে তার মোবাইলে ফোন করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে ধামরাই থানাকে জানালে ওই দিন রাতে পুলিশ সোনা মিয়ার বাড়ির পাশের মাজেদুল ইসলাম (২৭) ও মানছুর রহমান (২৫) নামে দুই অপহরণকারীকে গ্রেফতার করে। এরপর রাতভর জিজ্ঞাসাবাদে তারা মনির হোসেনকে শ্বাসরোধে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়ার কথা স্বীকার করে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, এরআগে, ৯ জানুয়ারি যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় এক স্কুলছাত্রকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনসার উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘উপজেলার গোপালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তারিফ হোসেনকে (৯) অহপরণ করে বিল্লাল নামে এক কিশোর। অপহরণের পর তারিফের বাবার কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় সে। ঘটনাটি পুলিশকে জানিয়ে অপহরণের এক লাখ টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেন। বিল্লাল টাকা তুলতে গেলে মোবাইল ট্রাকিংয়ের মাধ্যমে পুলিশ আটক করে তাকে। পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে বিল্লাল জানায়, তারিফকে এরইমধ্যে হত্যা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫০ জন শিশুকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে অপহরণের পর হত্যা করা হয় ৩১ শিশুকে। ওই বছর নিখোঁজ শিশুর সংখ্যা ছিল ২৩৩ জন।  এরমধ্যে হত্যা করা হয় ৮১ জনকে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুধবার (৩০ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘অপহরণের পর শিশুহত্যার বিষয়টি যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে পড়েছে। তবে অপরিচিত কেউ করছে বলে মনে হয় না। যারাই একাজের সঙ্গে জড়িত, তারা এসব শিশুর পরিবারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত। এমনকি ওই শিশু অপহরণকারীকে না চিনলে কখনোই যাবে না। পরিচিতজনরাই ডাকলে কোমল মনের অধিকারী শিশুরা তাদের কথা শুনছে। বিপদ হবে, সেটি তো ওই শিশু আগে থেকে বুঝতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘মাদকের ভয়াবহতা মূল্যবোধকে নষ্ট করে দিয়েছে। যদি মাদক নির্মূল হয়েও যায়, এরপরও এর ভয়াবহতা যেখানে পৌঁছেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে মূল্যবোধে ফিরতে অনেক সময় লাগবে।’

হঠাৎ করে অপহরণের পর শিশু হত্যার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকটি ধাপে শিশু নির্যাতন চলছে। এর কারণ সামাজিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুই ধরনের অবিভাবক দেখে থাকি। কোনো ক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাবা চাকরি করেন, মা বাড়িতে সন্তান পালন ও ঘরের কাজ করেন। যাই করুন না কেন কোনোমতেই বাচ্চাকে অন্যের হাতে তুলে দেবেন না। নিজের সন্তানকে দিতে হবে।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশীক মোহাম্মদ শিমুল বলেন, ‘শিশুহত্যা দেশে নতুন নয়। গণমাধ্যমের কারণে এ বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে মাত্র। এটা সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরই বহিঃপ্রকাশ। আর দেশে একের পর এক নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়া আর বিপরীতে যথাযথ বিচার না হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা কমে যাচ্ছে।’ যার ফলে শিশুরাও এ নির্মমতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বলেও মনে তিনি করেন।

সারাবাংলা/ইউজে/এমএনএইচ

অপহরণ শিশু অপহরণ শিশুহত্যা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর