প্রেস থেকে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস: শিক্ষার্থীসহ গ্রেফতার ৯
৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ১৫:৫০
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: প্রেস থেকে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। এ নিয়ে প্রশ্নফাঁসে জড়িত মূলহোতাসহ ৪৬ জনকে গ্রেফতার করা হলো।
সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া ৯ জন হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান রমিজ, গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিমন হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান সাইদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুহাইমিনুল ইসলাম, ঢাকা কলেজের পিয়ন মোশারফ হোসেন এবং ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অসীম বিশ্বাস জৈনক ব্যবসায়ী মাসুদ রহমান তাজুল, অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম, জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হাফিজুর রহমান হাফিজ।
বৃহস্পতিবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে সিআইডির কনফারেন্স হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত আইজিপি শেখ হিমায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের চলমান অভিযানে, ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াতি চক্রের অন্যতম হোতা হাফিজুর রহমান হাফিজ এবং মাসুদ রহমান তাজুলকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৪৬ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসকারীদের মূল উৎপাটন করা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়া, ডিজিটাল ডিভাইস জালিয়াতি চক্রের মূল হোতা ৬ জন। তারা হলেন, অলিপ কুমার বিশ্বাস, ইব্রাহিম মোল্যা, হাফিজুল রহমান হাফিজ, মাসুদুর রহমান তাজুল, মোস্তফা কামাল ও আইয়ুব আলী বাঁধন।
অলিপের সহযোগীরা হলেন, জাহাঙ্গীর আলম, প্রণয় পান্ডে, সৈয়দ শাকিল ও সাইদুর সাঈদ। ইব্রাহিম মোল্যার সহযোগীরা হলেন, মাহবুব মামুন ও জাহাঙ্গীর আলম। হাফিজুর রহমান হাফিজের সহযোগী হলেন রহমান রজিম। মাসুদুর রহমান তাজুলের সহযোগীরা হলেন, অসীম বিশ্বাস, শ্বাশ্বত ঘোষ, নেছার উদ্দিন লিমন ও রিমন হোসেন। মোস্তফা কামালের সহযোগী মাসুদ হাসান। আইযুব আলীর সহযোগীরা হলেন, রাসেল আলী ও আবদুল্লাহ রায়হান।
শেখ হিমায়েত হোসেন বলেন, প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মাস্টার-মাইন্ড হচ্ছেন পূর্বে গ্রেফতার হওয়া রাকিবুল হাসান এছামী। তাকে সহযোগিতা করতেন, খান বাহাদুর, সাইফুল ইসলাম, সজীব ইসলাম, বনি ইসরাইল, আশরাফুল ইসলাম আরিফ ও মারুফ হাসান।
প্রশ্নফাঁসে যেভাবে যারা জড়িত:
শুরুটা ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অভিযান চালিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত রানা ও মামুন নামের দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় ২০ অক্টোবর শাহবাগ থানায় দায়ের করা হয় একটি মামলা। গ্রেফতারকৃত দুই শিক্ষার্থীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষা হল থেকে গ্রেফতার করা হয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাফিকে।
গ্রেফতারকৃতদের দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তিগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সাত শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। ওই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জানা যায়, পরীক্ষার আগেই প্রেস থেকে ফাঁস হয়ে যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র। এই চক্রের মাস্টার-মাইন্ড নাটোর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান এছামী, প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, তার আত্মীয় সাইফুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বনি ও মারুফসহ ২৮ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। সংঘবদ্ধ এ চক্রটি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে। সাভারের একটি বাসায় আগের রাতে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পড়ানোর আয়োজন করা হতো।
দুই পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র জালিয়াতি:
ভর্তি কিংবা নিয়োগ পরীক্ষায় মূলত দুইভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে। অন্য চক্রটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তার সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষা হলে পরিক্ষার্থীকে সরবরাহ করে। আগের রাতে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁসকারী পুরো চক্র চিহ্নিত করা গেলেও ডিভাইস চক্রটি বাকি ছিল।
টানা কয়েকটি সাঁড়াশি অভিযান এর নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতি চক্রের মাস্টারমাইন্ড বিকেএসপি সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, মূল হোতা ৩৮তম বিসিএস নন ক্যাডার সুপারিশ প্রাপ্ত ইব্রাহিম মোল্যা, বিএডিসি সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল, আইয়ুব আলী বাধনসহ ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম।
বিসিএস পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস:
পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে প্রশ্নপত্র সরবরাহের অভিযোগে রাজধানীর অগ্রণী স্কুলের শিক্ষক গোলাম মোহাম্মদ বাবুল, অফিস সহায়ক(পিয়ন) আনোয়ার হোসেন মজুমদার এবং মোহাম্মদ নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই অভিযোগে ধানমন্ডি গর্ভমেন্ট বয়েজ স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক হোসনে আরা বেগম এবং পিয়ন হাসমত আলী শিকদারকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গ্রেফতারের সময় হাসমতের কাছে ওইদিনের বিসিএস এর লিখিত পরীক্ষার কয়েকটি প্রশ্ন পত্র এবং ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। চক্রটির ৬ জন মূল হোতার মধ্যে চক্রটির ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও জনতা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হাফিজুর রহমান হাফিজ এবং ব্যবসায়ী মাসুদ রহমান তাজুল ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। সর্বশেষ কয়েক দিনের অভিযানে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।
মাস্টার-মাইন্ডদের সহযোগী চক্র:
অলিপ, ইব্রাহিম, মোস্তফা, তাজুল, হাফিজ ও বাঁধন ডিজিটাল জালিয়াতি ৬ মূল হোতার প্রত্যেকের নিজস্ব সহযোগী চক্র ছিল। অভিযানে এদের সহযোগীদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অলিপের অন্যতম সহযোগী অগ্রণী ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার জাহাঙ্গীর আলম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান সাইদ, তাজুলের প্রধান সহযোগী ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অসীম বিশ্বাস, বেসরকারি গ্রীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রিমন হোসেন এবং ঢাকা কলেজের পিয়ন মোশারফ হোসেন মূসা এবং হাফিজুর রহমান হাফিজ।
এই চক্রটি বিসিএস ও ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের গ্রেফতার করা ভবিষ্যতে আর কোনো চক্র প্রশ্নফাঁস করতে পারবে না ও প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল উৎপাটন করা হয়েছে বলে দাবি সিআইডির।
সারাবাংলা/ইউজে/এনএইচ