প্রিমিয়ার সিমেন্টের অর্ধ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি
২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:৫১
।। শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: মেসার্স প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সিমেন্টের ওপর অপরিশোধিত ভ্যাট, তথা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮ টাকা ৭৫ পয়সার। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা কোনো ভ্যাট ফাঁকি দেয়নি। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রিমিয়ার সিমেন্টকে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের অর্থ পরিশোধ করতে বলেছে।
এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, মেসার্স প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সিমেন্টকে ২০১৬ সালের ১০ মে’র এক বিশেষ আদেশের সুবিধাপ্রাপ্ত পণ্য বলে উল্লেখ করে। এরপর অব্যাহতি পাওয়া পণ্য হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সিমেন্ট সরবরাহ করে প্রিমিয়ার সিমেন্ট।
কিন্তু এনবিআর আনুষাঙ্গিক দলিল অনুসন্ধান করে জানতে পারে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মনোনীত সাব-কন্ট্রাকটর ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও ট্রেস্ট রোসেম লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অব্যাহতি পাওয়া পণ্য হিসেবে সিমেন্ট সরবরাহ করে। একইসঙ্গে সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের বিপরীতে রেয়াত সুবিধাও নেয়। রেজিস্ট্রারেও তারা নিজেদের সরবরাহ করা সিমেন্টকে অব্যাহতি পাওয়া পণ্য হিসেবে দেখায়।
এনবিআরের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০১৮ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে রূপপুরে সরবরাহ করা সিমেন্ট উৎপাদনের বিপরীতে অব্যাহতি পাওয়া পণ্য হিসেবে চলতি রেজিস্ট্রারে প্রদর্শন আইনসম্মত হয়নি। একইসঙ্গে এনবিআরের বিশেষ আদেশ নম্বর ১১/মূসক/২০১৬ অনুযায়ী ২০১৬ সালের ১০ মে অনুযায়ী প্রিমিয়ার সিমেন্ট অব্যাহতি পাওয়া পণ্য সরবরাহ করার আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠান নয়। ফলে তারা ২০১৮ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সিমেন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের বিপরীতে যে রেয়াত সুবিধা নিয়েছে, তাও আইন বহির্ভূত।
এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রিমিয়ার সিমেন্ট ২০১৮ সালের মার্চে ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬০ টাকার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে আদায়যোগ্য ভ্যাটের পরিমাণ ১৮ লাখ ৫০ হাজার ৪৯ টাকা। পরের মাস এপ্রিলে তাদের ৩৫ লাখ ৯৯ হাজার ৭৫০ টাকার সিমেন্টের বিপরীতে আদায়যোগ্য ভ্যাটের পরিমাণ ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৯৬২ টাকা ৫০ পয়সা। একইভাবে জুনে বিক্রি করা ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৮৬ টাকার সিমেন্টের বিপরীতে আদায়যোগ্য ভ্যাট পরিমাণ ৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৭ টাকা ৯০ পয়সা, জুলাই মাসে বিক্রি করা ১৯ লাখ ৭১ হাজার ১২০ টাকার বিপরীতে আদায়যোগ্য ভ্যাট পরিমাণ ২ লাখ ৯৫ হাজার ৬৬৮ টাকা, আগস্ট মাসে বিক্রি করা ৩৬ লাখ ২২ হাজার ৪৮০ টাকার সিমেন্টের বিপরীতে আদায়যোগ্য ভ্যাট ৫ লাখ ৪৩ হাজার ৩৭২ টাকা এবং সেপ্টেম্বর মাসে বিক্রি করা ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার ১২৯ টাকার সিমেন্টের ওপর ভ্যাট আসে ১১ লাখ ৭ হাজার ৭৬৯ টাকা ৩৫ পয়সা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মোট ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮ টাকা ৭৫ পয়সার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
এনবিআর বলছে, প্রিমিয়ার সিমেন্টের এই কর অব্যাহতির সুবিধা গ্রহণ মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ০৬ ও ধারা ৩৫; মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা, ১৯৯১-এর বিধি ২৩ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষ আদেশ ১১/মূসক/২০১৬-এর পরিপন্থি। একইসঙ্গে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের মোট টাকা মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১-এর ধারা ৫৫(১) মোতাবেক দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটিকে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, এর আগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৪১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৬৮ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার প্রমাণ পায় মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিরীক্ষা এবং গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। এনবিআরের সংস্থাটির এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে ফাঁকির বিষয়টি। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকার কর ফাঁকি দেয়। উৎসে মূসক, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণ এবং কম উপকরণ দিয়ে পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি তখন ওই ফাঁকি দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের কোম্পানি সেক্রেটারি কাজী এমডি শফিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আমরা এনবিআরের কাছে দুই মাসের সময় চেয়েছি। এনবিআরও আমাদের সময়ের আবেদন মঞ্জুর করেছে। অপেক্ষা করুন, পরে জানান। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের এনবিআর থেকে সরবরাহ করা একটি সার্কুলার দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে সিমেন্ট সরবরাহ করা হবে, সেটা ভ্যাট ফ্রি। আমরা ভ্যাট ছাড়াই তাদেরকে সিমেন্ট সরবরাহ করেছি। কিন্তু এনবিআর বলছে, এতে ভ্যাট দিতে হবে।
শফিকুর রহমান আরও বলেন, এনবিআর থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একটি সার্কুলার দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, তারা (বিদ্যুৎকেন্দ্র) যদি স্থানীয়ভাবে পণ্য কেনে, তাহলে সেটার ভ্যাট হবে শূন্য। কিন্তু এখন এনবিআর বলছে, সিমেন্ট কোম্পানি এই সুবিধা পাবে না। এখন ওই সার্কুলার অনুযায়ী আমরা রূপপুরে সিমেন্ট সরবরাহ করেছি ভ্যাট ছাড়াই। এখন তাদের আমরা জানিয়েছি এবং ভ্যাটের টাকা দিতে বলেছি। বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করে দিলে আমরা এনবিআরকে ভ্যাট পরিশোধ করে দেবো।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে তারা দেশের শত্রু। তারা কখনও দেশের উন্নয়ন চান না। এজন্য নিজেরা লাভবান হওয়ার আশার ভ্যাট ফাঁকি দেন। সেই কাজটি প্রিমিয়ার সিমেন্টও করেছে। তারা যে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে সেটা তাদেরই পরিশোধ করতেই হবে। এনবিআর রাজস্ব আদায়ে বদ্ধপরিকর। যারা ফাঁকি দেবে তাদেরকে পাকড়াও করা হবে।’
সারাবাংলা/এসজে/টিআর