অভিযোগ পেয়ে চট্টগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় আচমকা ভূমিমন্ত্রী
৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:০৯
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম: বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পর হঠাৎ করে চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা পরিদর্শনে করেছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এর মধ্য দিয়ে ‘দুর্নীতি ও হয়রানি’ রোধে নিজ জেলা থেকেই নিজ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলোতে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ শুরু করলেন মন্ত্রী।
রোববার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল পৌনে বারোটায় তিনি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার বিভিন্ন অফিসে প্রবেশ করেন। এসময় মন্ত্রী দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের কাজের খোঁজখবর নেন। মন্ত্রীকে পেয়ে বিভিন্ন অভিযোগ জানান ভুক্তভোগীরা।
মন্ত্রী ভূমি অধিগ্রহণ শাখার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশিদের কক্ষে বসে ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের বিভিন্ন অভিযোগ শোনেন। খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মো.ইলিয়াস হোসেন সেখানে ছুটে যান।
এসময় মন্ত্রী ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বোদি চাকমাকে ডেকে নেন। তাকে উদ্দেশ্য করে মন্ত্রী বলেন, ‘তোমার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ আসছে কেন ? তুমি মানুষকে এত হয়রানি কর কেন? একটা বিষয় তৈরি হয়েছে, যদি ভুক্তভোগী কেউ ওপরে অভিযোগ করে, তখন নিচের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রতিশোধ নিতে হয়রানি আরও বাড়িয়ে দেন।’
মন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে বিদর্শী জানান, তিনি দুই বছর ধরে ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় আছেন।
এসময় জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক উভয়ে বিদর্শীর বিরুদ্ধে অভিযোগের জবাব দেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশিদ মন্ত্রীকে বলেন, ‘সে (বিদর্শী) চট্টগ্রামে যত বড় বড় প্রকল্প হয়েছে, সবগুলোর কাজ করছে। তার হাত দিয়েই সব হচ্ছে। সে খুব এফিশিয়েন্ট।’
জেলা প্রশাসক মন্ত্রীকে বলেন, ‘আমাদের বাইরে একটা দালাল চক্র আছে। ভেতরেও যে কেউ নেই সেটা বলব না। সার্ভেয়ারদের একটা গ্রুপ আছে। তবে দালালদের আর্থিক বুনিয়াদ এত শক্ত যে, অনেক সময় কিছু করতে পারি না। কিছু করতে গেলেই তারা অভিযোগ করে বসে। আমাদের অফিসের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাকে বদলি করে দিচ্ছি। একইসঙ্গে চক্রটাকে ধরার চেষ্টা করছি। দুর্নীতি দমন কমিশনকে বলেছি।’
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়া টাকা থেকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ কেটে রাখার অভিযোগ পাবার কথা জানান মন্ত্রী।
এ বিষয়ে জবাব চাইলে জেলা প্রশাসক আবারও চক্রের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘অনেক সময় দেখেছি, আমি নিজে বাড়িতে গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক হাতে তুলে দিয়ে এসেছি। সেই চেক দেখি আবার দালালের হাতে চলে গেছে। এটা কিভাবে যাচ্ছে ?’
বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা থেকে আসা মো.সিহাব উদ্দিন মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন- তার ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ফাইল একমাস আগে সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমার কাছে পাঠানো হলেও তিনি সেটি ক্ষতিপূরণের জন্য তৈরি করে দিচ্ছেন না। তার কাছে গেলে জানানো হয়, ফাইলটি তিনি বাসায় রেখে এসেছেন। এরপর আরেকবার গেলে বলা হয়- পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মূল কপি নিয়ে যেতে। সেটি নিয়ে জমা দেওয়ার পর তাকে রোববার (০৩ ফেব্রুয়ারি) আসতে বলা হয়। রোববার গেলে তাকে জানানো হয়, ফাইল এবং পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মূল কপি পরমেশ্বর বাসায় রেখে এসেছেন। এভাবে একমাস ধরে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে।
এসময় মন্ত্রী পরমেশ্বর চাকমাকে ডেকে নেন। মন্ত্রী তাকে বলেন, ‘তুমি কি অনেক বড় অফিসার হয়ে গেছ? মন্ত্রীর চেয়েও বড় হয়ে গেছ? গুরুত্বপূর্ণ ফাইল তুমি নিজের বাসায় কেন নিয়ে যাবে? এই প্রবণতা কেন?’
জবাবে পরমেশ্বর চাকমা বলেন- ‘আমি সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলতেই আমার অফিস সময় শেষ হয়ে যায়। আরও অধিকতর সেবা দেওয়ার জন্য আমি বাসায় ফাইল নিয়ে যায়। বাসায় বসে কাজ করি।’
নগরীর কালামিয়া বাজার থেকে আসা আব্দুল মোতালেব মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন, অধিগ্রহণ করা তার জমির ক্ষতিপূরণের জন্য জেলা প্রশাসনে এসে জানতে পারেন, সেই জমির নামজারি অন্যজনের নামে হয়ে গেছে। এ বিষয়ে মামলা দায়েরের পর সেটি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না। বরং পাওয়ার অব এটর্নির কাগজ নিয়ে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে।
এসময় জেলা প্রশাসক সিহাব ও মোতালেব দুজনের কাছে কেউ টাকাপয়সা চেয়েছে কি-না জানতে চান। তিনি কেউ টাকা দাবি করেননি বলে জানান।
জেলা প্রশাসক মন্ত্রীকে বলেন, ‘কেউ টাকা চাননি। অভিযোগ সময়ের। আমাদের লোকজনের ধৈর্যের এত অভাব ! কাজ করার জন্য তো সময় লাগে। সেটাও দেবে না।’
এসময় মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমাকে সর্তক করেন এবং পরবর্তীতে অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান।
পরিদর্শনের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের ভূমিমন্ত্রী বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখতে এখানে এসেছি। প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ও এখানে এসেছিলাম। উপরের লেভেলে অনেক স্বচ্ছতা এসেছে। আমার মন্ত্রণালয়েও অনেক ঠিক হয়েছে। উপরের লেভেলে অলমোস্ট ৯০ পারসেন্ট ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু নিচের লেভেলের কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি বেশি।’
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি চেক দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা দালালদের হাতে যাচ্ছে। কিভাবে হচ্ছে তা বুঝছি না। এজন্য ইএফটি (ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার) পদ্ধতি চালুর চিন্তা করছি।
ইএফটি বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, আবেদনের পর টাকা সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে চলে যাবে এবং সেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এতে হয়রানি থাকবে না।
এসময় উপস্থিত ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হয়রানি যাতে না হয় সেভাবে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স। আমরা নিজেরাও চাই জনগণ যাতে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার না হয়। হয়রানি ও দুর্নীতি এখানে থাকতে পারবে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘মাইন্ড সেটআপ’ ও পদ্ধতি পাল্টাতে হবে।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা) আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ গত মন্ত্রীসভায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র সন্তান জাবেদকে এবার পূর্ণমন্ত্রী করে একই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/আরডি/এনএইচ