Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেরিকোর শত কোটি টাকার ভ্যাট আদায় নিয়ে সংশয়


৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৭:১৪

।। শেখ জাহিদুজ্জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: সরকারের ৮২ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩১ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান মেসার্স মেরিকো বাংলাদেশ লিমিটেড। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছর পার হলেও মেরিকোর ফাঁকি দেওয়া ওই ভ্যাটের অর্থ আদায় হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তদবির আর সুপারিশের কারণে ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি থমকে আছে। ফলে মেরিকোর ফাঁকি দেওয়া রাজস্ব আদৌ আদায় হবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ন্ত্রণাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) থেকে তৃতীয়বার নতুন করে মেরিকোর ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি তদন্তে টিম গঠন করে। সেই টিম গত বছরের আগস্টে মেরিকোর ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু এনবিআরের উচ্চপদস্থ ও সরকারের ‘উপরমহলের’ কর্মকর্তাদের তোপের মুখে সেই প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এলটিইউ সূত্রে জানা যায়, মেসার্স মেরিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর একটি তদন্ত টিম গঠন করে। সেই তদন্ত টিম মেরিকো কোম্পানির ৮২ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩১ টাকার ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি উদঘাটন করে তার পরের বছর।

সেই তদন্ত কমিটি মেরিকো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানটির তখনকার ক্রয় হিসাবে উৎপাদিত ৫০০এমএল এর ৩০ হাজার ৩৯৮ পিস প্যারাসুট কোকোনাট অয়েল লিপিবদ্ধ পায়। কিন্তু গুদাম পরিদর্শন করে ২০ হাজার ৩৯৮ পিস বোতল পায় তদন্ত টিম। এ বিষয়ে তখনকার প্রতিষ্ঠানের সহকারী ম্যানেজার মো. খায়রুল আলম রুবেল অনুসন্ধানী টিমকে জানান, ১০ হাজার পিস নারিকেল তেলের বোতল গাজীপুরে অবস্থিত প্রত্যাশা গুদামে আছে। এরপর তদন্ত দল গাজীপুরের গুদাম পরিদর্শনে গিয়ে ১০ হাজার পিস বোতল প্যরাসুট তেলের জুদ দেখতে পান। তবে গুদামে রাখা পণ্য মেরিকো কোম্পানির কিনা সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

বিজ্ঞাপন

সেই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, উৎপাদন স্থল থেকে প্যারাসুট কোকোনাট অয়েলের বোতল অপসারণের মাধ্যমে প্রযোজ্য মূসক পরিশোধের বিষয়টি সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছে মেরিকো বাংলাদেশ। অপসারণকৃত পণ্যের একেকটি মূল্য (তৎকালীন) ১৩৩ টাকা ৩৪ পয়সা। সে হিসাবে ১০ হাজার পিস প্যারাসুট কোকোনাট অয়েলের মূল্য দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা। যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসকের পরিমাণ ২ লাখ ১০ টাকা। অর্থাৎ যা ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে তখন এনবিআরের সিআইসি সেল থেকে মেরিকো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠানটির ২০০৮ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত কোপরা আমদানির তথ্য নেয় বহৎ করদাতা ইউনিটের তদন্ত টিম।

যেখানে দেখা যায়, মেরিকো বাংলাদেশ ওই সময়কালে ৫২৪ কোটি ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৫ টাকার কোপরা আমদানি করেছে। যার উপর প্রদেয় মূসক বাবদ ৮২ কোটি ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৩২১ টাকা চলতি হিসাবে রেয়াত নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই অর্থও ফাঁকি দিয়েছে মেরিকো।

গঠিত তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তখন আরও বলা হয়, মেরিকো বাংলাদেশ নারিকেল তেল উৎপাদনের কাঁচামালের কোপরা আমদানির বিল অব এন্ট্রি ক্রয় পুস্তকে (মূসক-১৬) লিপিবদ্ধ করেছে। যার মাধ্যমে চলতি হিসাব পুস্তকের (মূসক-১৮) মাধ্যমে রেয়াত নেওয়া হয়েছে। আমদানিকৃত কোপরা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস করার পর তা আর উৎপাদন স্থানে আনা হয়নি। আর এই খালাসকৃত পণ্য মেরিকো কোম্পানির চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোস্তফা অয়েল ও ইকো অয়েল নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানে যায়। যার ফলে দুর্নীতি হয়েছে এবং মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এর ধারা (ট) (ঠ) এবং একই আইনের বিধি ১৯(২) এর পরিপন্থী হওয়ায় রেয়াত বাতিলযোগ্য।

এলটিইউ সূত্রে আরও জানা যায়, মেরিকো বাংলাদেশ ১০ হাজার পিস প্যারাসুট কোকোনাট অয়েলে অপসারণের মাধ্যমে ২ লাখ ১০ টাকার মূসক ফাঁকি ও ৮২ কোটি ৩৯ লাখ ২৭ হাজার ৩২১ টাকা রেয়াত নিয়েছে। সব মিলিয়ে ফাঁকিকৃত মোট রাজস্বের পরিমাণ ৮২ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩১ টাকা। যা ফাঁকি হিসেবে গণ্য হওয়ায় আদায়যোগ্য।

আর এই ভ্যাট ফাঁকির তদন্ত প্রতিবেদন বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) ২০১২ সালের ১ মার্চ দাখিল করে তদন্ত কমিটি। এরপর ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের অর্থ আদায়ে ২০১২ সালের ১২ মার্চ মেরিকোকে চিঠি দেন তৎকালীন কমিশনার ব্যারিস্টার জাহাঙ্গীর হোসেন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেম্বার ভ্যাট)। সেই চিঠিতে তখনকার কমিশনার অর্থ পরিশোধের জন্য ১০ দিন সময় বেঁধে দেন এবং কোনো বক্তব্য থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে কমিশনার বরাবর দাখিল করতে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশ দেন।

এলটিইউ ‍সূত্রে জানায়, ২০১২ সালের ১২ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার পর এনবিআরের চাপ ও সরকারের উপরিমহলের চাপে আবার এলটিইউ নতুন করে আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এরপর সেই তদন্ত টিম ২০১২ সালের শেষের দিকে মেরিকো বাংলাদেশ কোনো ভ্যাট ফাঁকি দেয়নি বলে প্রতিবেদন দেয়। তখন প্রথম অনুসন্ধানকারীরা এটার বিরোধিতা করলে সেখানেই মেরিকোর ভ্যাট ফাঁকি বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এরপর দীর্ঘসময় পর ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এলটিইউ এর সাবেক কমিশনার মতিউর রহমান একটি নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। কিন্তু এই তদন্ত কমিটি ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেলেও আবারও তদবিরে বন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া ফাঁকিকৃত ভ্যাট পরিশোধ না করা পর্যন্ত প্রতি মাসে ২ শতাংশ হারে সুদ প্রযোজ্য। ফলে ৭ দীর্ঘ সাত বছরে মেরিকোর ফাঁকিকৃত ভ্যাটের সঙ্গে শুধু সুদযুক্ত হয়েছে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। ফলে ফাঁকিকৃত ভ্যাটের পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২২২ কোটি টাকা।

মেরিকো বাংলাদেশ লিমিটেডের কোম্পানি সেক্রেটারি ক্রিস্টাবেল র‌্যান্ডলফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। অচিরেই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান হবে। এছাড়া এনবিআরও বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। ফলে এনবিআর যদি আমাদেরকে রাজস্ব পরিশোধ করতে বলে তাহলে আমরা অবশ্যই রাজস্ব পরিশোধ করব।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কমিশনার মুহাম্মদ মুবিনুল কবীর সারাবাংলার কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেরিকোর ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি তারা ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে থাকে তাহলে দ্রুত ভ্যাট আদায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সারাবাংলা/এসজে/এমও

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর