সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে বদলান, নয়তো পস্তান!
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৭:৪০
।। সারাবাংলা ডেস্ক ।।
অ্যান্ড্রোয়েডের সঙ্গে চুক্তি না করার মতো ছোট্ট একটা ভুলে ডুবতে হয়েছে নোকিয়া করপোরেশনকে। মোবাইল ফোনের এক সময়কার জায়ান্ট এখন মাক্রোসফটের দখলে। আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে টাইটানিকের যে অবস্থা হয়েছিল, নোকিয়ার অবস্থাও আজ ঠিক সেই অবস্থায়।
শুরুটা ২০১০ সালের দিকে। সেবছর থেকে বাজারে আসতে শুরু করে আইফোন ও অ্যান্ড্রোয়েড চালিত স্মার্টফোন। ব্যাপক সাড়াও ফেলতে শুরু করে মোবাইল ফোনের জগতে। প্রথম ধাক্কায় বাজার হারিয়ে ১ হাজার ৮০০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করে নোকিয়া। তারপর স্টিফেন ইলোপ নতুন সিইও হিসেবে দায়িত্ব নিলেও কাজের কাজ কিছু হয়নি। এরই মধ্যে অ্যান্ড্রোয়েড ফোন বাজারে এতটা প্রতিযোগিতা শুরু করে যে নতুন করে আর ওখানে কিছু করার নেই। ফলে নোকিয়ার দীর্ঘদিনের গ্রাহকরাও শেষ পর্যন্ত আগ্রহ হারায়। তারাও ঝুঁকে পড়ে স্যামস্যাং, এলজি ও হুয়াইয়ের মতো কোম্পানির অ্যান্ড্রোয়েড ফোনের দিকে। কয়েক বছরের মধ্যে গোটা ফোনের বাজার চলে যায় এসব কোম্পানির দখলে।
এর ঠিক দুবছরের মাথায় ২০১২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি স্যামসাংয়ের কাছে সেরা মোবাইল ফোন নির্মাতার মুকুটটিও হারিয়ে ফেলে নোকিয়া। শেষ পর্যন্ত বিশাল লোকসান পড়ে আরও ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। টিকে থাকা যখন অনেকাংশেই অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন ৫.৪ বিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে মাইক্রোসফটের কাছে সত্ত্ব বিক্রি করে বাজার ছাড়ে নোকিয়া।
পাঠক, কেবল নোকিয়ার নয় এমন করে নাম হারানো মান হারানোর গল্প আরও রয়েছে। সময়ের পরিবর্তনে প্রযুক্তির উৎকর্ষে কিংবা অগ্রগতিতে এক সময়ে মাথা তুলে থাকা অনেক কোম্পানিই এখন চোখের আড়ালে চলে গেছে।
নোকিয়ার মতো ভুরি ভুরি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ আছে যারা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হওয়ায় হারিয়ে গেছে সময়ের গর্ভে।
কেবল যে মোবাইল ফোন তা নয়, এ তালিকায় রয়েছে, ক্যামেরা, কম্পিউটার, ঘড়ি, গাড়ি, এমনকি এয়ারলাইন্স, উড়োজাহাজের মতো ব্র্যান্ড নেম।
৯০-এর দশকের শুরুর দিকেও কোডাক ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পাঁচটি ব্র্যান্ডের ব্রান্ডের একটি। ১৯৯৮ সালেও প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কর্মচারী কাজ করতো কোডাক কোম্পানিতে। সেসময় আমেরিকার ৯০ ভাগ ফিল্মের বাজার আর ৮৫ ভাগ ক্যামেরার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো কোডাক। বলতে গেলে, ফটোগ্রাফিক বাজারে তখন কোডাক ছিল অপরিহার্য। সেই কোডাক কোম্পানি ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার একটি আদালতে ১১ নং ধারায় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে। কোম্পানিটি সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে পড়ে এবং সমস্ত কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছাঁটাই করে। তবে এর পেছনের কারণ হিসেবে ছিল তাদের নিজেদেরই উদ্ভাবিত ডিজিটাল ক্যামেরা এবং নিজেকে সময়োপযোগি করে তুলতে ব্যর্থ হওয়া। কোডাক তখন ফিল্মের বাইরে অন্য কিছু বুঝতেই চায়নি। তার কারণও ছিল কোডাক নিজেই ব্যবসা করতো ফটোগ্রাফির প্রত্যেকটি খাতে। ক্যামেরা, ফিল্ম, ফিল্ম ডেভেলপের কেমিক্যাল এবং ফটোগ্রাফিক পেপার- প্রত্যেকটি খাতে কোডাকের পণ্যই বাজার দখলে রেখেছিল।
ডিজিটাল ক্যামেরার উদ্ভাবন নিয়ে প্রথম থেকে খুব বেশি মাথা ঘামায়নি কোডাক যা শেষ পর্যন্ত তার নিজেরই দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। বেশ পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে ডিজিটালের পথে যাত্রাও করে কোডাক। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। ক্যামেরার বাজার ততদিনে সনি, ক্যানন, নাইকন কিংবা অলিম্পাসদের দখলে।
এক সময় প্যান অ্যামেরিকান ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ বা ‘প্যান এম’ ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা এয়ার লাইন্স কোম্পানি। সেই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যও।
১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর ৫০ ও ৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিলাশবহুল এয়ারলাইন্সের তালিকায়ও স্থান করে নেয় প্যান এম। তবে ৭০-এর দশক থেকে তারা অব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শীতার অভাবে অন্যান্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। এরসঙ্গে যোগ হয় ১৯৮৮ সালে লকারবি বিমান দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় পড়ে প্যান অ্যামিরিকান এয়ারলাইন্সের প্যান এম ফ্লাইট-১০৩ বিমানটি। সন্ত্রাসী হামলায় ওই বিমানে থাকা ২৪৩ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়।
এর পরই চূড়ান্ত ধস নামে প্যান এমে। যদিও এরপর আরও তিন বছর ধুকে ধুকে চলার পর ১৯৯১ সালে কোম্পানিটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শুধু সমযোপযোগি হলেও চলে না এর সঙ্গে থাকা চাই ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও স্বচ্ছ একটি ধারণা। ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর উদাহরণও তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে। যেমন তথ্যপ্রযুক্তিতে এই সময়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নাম লিখিয়েছে ইয়াহু। নিজের সময়টাকে ঠিক মতো বুঝতে ব্যর্থ হওয়া এবং ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা করতে না পারায় কোম্পানিটি এখন ব্যর্থ হিসেবেই নাম লিখিয়েছে। ১৯৯৪ সালে যাত্রা করে মেইল, সার্চ ইঞ্জিন, নিউজ, ফিন্যান্স, স্পোর্টস ও মেসেঞ্জারের মতো সেবা দেওয়া শুরু করলেও অদূরদর্শীতার কারণে গ্রাহকের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে ব্যর্থ হয় ইয়াহু। এর ঠিক চারবছর পর ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করেও একই ধরনের সেবা দিয়ে ইয়াহুকে হারিয়ে শীর্ষ স্থান দখল করে নেয় গুগল। এখন তো গুগলের কোনো একটি আউটলেটের সঙ্গে না থেকে একটা দিনও পার করা অসম্ভব।
ট্যাক্সি সার্ভিসের দাপটের দিনগুলো কার না জানা। তবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের মেল বন্ধণ তাতে ছিলো না। জানা ছিলো না একসময় দারণ সফলতার এসে যাবে অ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবা নেটওয়ার্ক। উবার’র মতো কিছু একটা। আমেরিকা ভিত্তিক অনলাইন পরিবহন নেটওয়ার্ক কোম্পানি উবারের নিজস্ব কোনো ট্যাক্সি নেই। তারপরও ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেভিনিউ নিয়ে উবার এখন বিশ্বের বৃহত্তম ট্যাক্সি ভাড়ার কোম্পানি। উবারের কিছু নির্ধারিত যোগ্যতা পূরণ করে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক যে কেউ উবার টিমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একজন চালক ও যাত্রী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে নিতে পারেন। উবারের ফ্রি অ্যাপটির মাধ্যমে একজন যাত্রী নিজের অবস্থান জানিয়ে একটি ট্যাক্সি ডেকে আনতে পারেন। আর একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে উবার।
বর্তমান ভবিষ্যতের মেলবন্ধণ সৃষ্টি করে এমন আরও অনেক কিছুই এখন আসছে কিংবা এসে পড়েছে। সুতরাং সতর্ক ও সচেতনতায় সেগুলোর ব্যবহারে আকৃষ্ট ও আগ্রহী হয়ে ওঠাই আধুনিক মানুষের কাজ।
এয়ার বিএনবি’র কথাই ধরুন। নাম শুনলে কোনো একটি এয়ারলাইন্স বলেই মনে হয়। বাস্তবে এটি একটি অভিনব হোটেল ব্যবসা। যেখানে বাণিজ্যিক হোটেলগুলোর তুলনায় অনেকটা স্বল্পমূল্যে থাকতে পারেন অতিথিরা। নিজস্ব একটা বাড়ি থাকলে যে কেউই হতে পারেন এই এয়ার বিএনবির মালিক। অথবা এয়ার বিএনবির জন্য অনুমতি সহকারে বাড়ি ভাড়া নিয়েও এই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। অনেকটা উবার ব্যবসার মতো। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এয়ার বিএনবি। এই স্টার্টআপের বর্তমান সিইও ব্রায়ান চেস্কি। মূলত বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেওয়ার মার্কেট প্লেস হিসেবে কাজ করে এয়ার বিএনবি।
১৯০টি দেশে কার্যক্রম রয়েছে এয়ার বিএনবির। এরই মধ্যে কোম্পানিটির বর্তমান বাজারমূল্য ১০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এর শুরুর কাহিনী অবশ্য বেশ মজার, ২০০৭ সালে একটি কনফারেন্সে যান ব্রায়ান চেস্কি। সেখানে গিয়ে কোনো হোটেলে রুম না পাওয়ার পর এই বিজনেসের আইডিয়াটা আসে তার মাথায়।
ভবিষ্যতে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হলে এক সময় কিছু পেশার মানুষকেও চাকরি হারাতে হতে পারে। আজকের আমেরিকায় ওকালতি ও ডাক্তারি পেশায় বিকল্প হিসেবে দেখা দিয়েছে আইবিএম ওয়াটসন নামের একটি সফটওয়্যারকে। এর একটি সফটওয়্যার যেকোনো নতুন উকিলের চেয়ে ভালো ওকালতি করতে পারে। কয়েক বছর সফটওয়্যারটির আরও বেশি উন্নতি হলে হয়তো আইন পেশায় কিছু বিশেষজ্ঞ উকিল ছাড়া কারও চাকরি করা লাগবে না। এছাড়া ওয়াটসনের আরেকটি সফটওয়্যার মানুষের চেয়ে চারগুণ নিখুঁতভাবে ক্যানসার ও অন্যান্য রোগ শনাক্ত করতে পারে। আসছে দশকের মধ্যেই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে ছাপিয়ে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে চীন। ২০১৭ সালে চীনের স্ট্রেট কাউন্সিলের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে এ শিল্পে ১৪৭ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে চীনে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশ্বের শীর্ষ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এইআই) ইন্ড্রাস্ট্রি ও এআই ইনোভেশন সেন্টার। চীনের জনগণ এই প্রযুক্তির উন্নয়নে সরকারের নীতি ও ব্যয়কে বেশ আগ্রহের সঙ্গে নিয়েছে। এর ফলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, হিসাব নিরীক্ষা, চাকরির সাক্ষাৎকার, রোগ নির্ণয়, টেলিমার্কেটিং, রিসেপসনিস্ট এবং শিল্পকারখানাগুলোতে মানুষের বিকল্প হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হবে।
সারাবাংলা/এমআই