অসচেতনতা এবং আর্থিক অসচ্ছলতায় বোঝা হচ্ছে ক্যান্সার
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৬:৩২
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে বসে আছেন নীলুফার বেগম। মাদারীপুরের সদর থেকে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। ছেলে কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন, আর নীলুফার বেগম বসে আছেন জরুরি বিভাগের সামনের এক খোলা জায়গায়। নীলুফার বেগম জানালেন, তার গলায় ক্যান্সার ধরা পরেছে দেড় বছর আগে। এতোদিন নানা ধরনের চিকিৎসা করিয়েছেন, কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। তারপরও ছেলে গত দু’দিন আগে এই হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে বলে নিয়ে এসেছে।
নীলুফার বেগম জানান, প্রথমদিকে জমানো টাকা, তারপর নিজের গয়না, এমনকি ছেলের বউরাও তাদের গয়না হাতে তুলে দিয়েছিলেন, বিক্রি করেছেন জমি, তাতেও হয়নি। এখন দুবাই প্রবাসী দুই ভাইয়ের কাছ থেকে দেনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘পানির মতো টাকা যাচ্ছে কিন্তু সুস্থ হচ্ছি না। এবার দেশে এখানেই শেষ দেখাবো যদি সুস্থ না হই তাহলে আর কিছু করার নাই। সহায়-সম্বল যা ছিল সব শেষ, ঘরে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
কেবল নীলুফার বেগম নন, তার মতো অসংখ্য ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন, ভিটা-মাটি সব হারিয়ে তারা প্রায় কোনোরকমে বেঁচে আছেন।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক অনুমিত হিসাবে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। আর এর মধ্যে মারা যান প্রায় ১ লাখ আট হাজার।
অনানুষ্ঠানিক এই জরিপে বলা হয়, ক্যান্সার রোগীদের এক তৃতীয়াংশের মতো রোগী দেশের স্বীকৃত চিকিৎসা ব্যবস্থার আওতায় আসছেন। বাকিদের একটা অংশ বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন কিংবা নানা অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নিচ্ছে। আর বিপুল সংখ্যক রোগী ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। অজ্ঞতা, অসচেতনতা এবং ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সুবিধা অতি-কেন্দ্রীভূত হওয়ায় রোগ ধরা পরে দেরিতে।’ তারা বলছেন, ‘ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকির জন্য গঠিত উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল প্রায় অকার্যকর। ক্যান্সার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে। এছাড়া ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থা রোগীর চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তাই দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে সারাদেশ থেকে আসা রোগীদের ভিড় লেগেই থাকে। ফলে অপারেশনের জন্য একমাস, কেমোথেরাপির জন্য ২-৩ সপ্তাহ আর বিকিরণ চিকিৎসার জন্য অনেককে ৪ মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (অ্যাকশন স্টাডি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সার নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যে শতকরা প্রায় পঁচাত্তর ভাগ রোগী হয় মারা যান কিংবা ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়।
জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ রোগীরা ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতায় পড়ছেন, ধনী শ্রেণির রোগী ছাড়া। আর ধনী যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আবার বেশিরভাগই দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন। আর দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেখানে সবার পক্ষে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না, মাঝপথেই চিকিৎসা থামিয়ে দিতে হয়।’
‘আর সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে অসহনীয় চাপ এবং বিভিন্ন থেরাপি, অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। সরকারিতে যেহেতু লম্বা সিরিয়াল তাই বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পাঁচ থেকে দশগুণ খরচ বেড়ে যায়। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মানুষ আর্থিক অসচ্ছলতায় বিপর্যয়ে পড়েন’, মন্তব্য করেন ডা. রাসকিন।
সবচেয়ে বিপদজনক বিষয় হচ্ছে অনেকে চিকিৎসা শেষ করতে পারছেন না মন্তব্য করে ডা. রাসকিন বলেন, ‘যার কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সবার নাগালের মধ্যে নিতে হবে, যেখানে যে পর্যায়ে যতটুকু সম্ভব হয়। একইসঙ্গে বেসরকারি চিকিৎসাব্যয়ের নাগাল টানতে হবে। তবে এরজন্য সরকারি নীতিমালা থাকতে হবে। কারণ ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্প্রসারণের পাশাপাশি এর বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।’
ঢাকার বাইরে ৮টি বিভাগে ৮টি আঞ্চলিক ক্যান্সার কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কেন্দ্রগুলো ছোট হলেও হবে সমন্বিত।’
আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলোজি বিভাগের সাবেক প্রধান এবং হেলথ ইকোনোমিস্ট অধ্যাপক গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ১৬০টি কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারের প্রয়োজন থাকলেও রয়েছে মাত্র ২০টি। তাই সব মেডিকেল কলেজে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির সুবিধাযুক্ত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন যন্ত্র আমদানিতে শুল্ক ও কর অব্যাহিত প্রদান ও এর শর্ত হিসেবে শতকরা অন্তত ১০ ভাগ বেড দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে রাখার বিধান রাখতে হবে।’
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্যান্সার স্ক্রিনিং ও সীমিত চিকিৎসা সেবা যুক্ত করতে হবে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, ‘দেশে ১৬০টি কম্প্রিহেনসিভ ক্যান্সার সেন্টারের প্রয়োজন। আছে মোটে ২০টি। এছাড়া দেশি হাসপাতালগুলোয় মানসম্মত মেশিনের অভাবও রয়েছে। হাসপাতালগুলোর পুরনো মেশিন সরিয়ে নতুন মেশিন আনতে হবে যেন সেগুলো দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে না থাকে। দরিদ্র রোগীদের যেন সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে বেসরকারিতে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা করাতে না হয়।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মুজাহেরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব যেমন রয়েছে তেমনি আমাদের নিজেদের দায়িত্বও রয়েছে, সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের মতো গরীব দেশের মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। আমাদের যেখানে আউট অব পকেট এক্সপেনডেচার (নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটানো) ৬৭ শতাংশ, আর এটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে একে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।’
একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই খরচকে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে জানিয়ে মুজাহেরুল হক বলেন, ‘কিন্তু সেজন্য সরকারের কোনো প্রচেষ্টা নেই, এটা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।’
সারাবাংলা/জেএ/এমও/পিএ