হাইকোর্ট মাজারে লুট: চোরের সহযোগিতায় চোর ধরবে পুলিশ
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:০৭
।। উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: হাইকোর্ট মাজারের ১২টি সিন্দুক ভেঙে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও বৈদেশিক মুদ্রা চুরির ঘটনায় মূল আসামিকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। এবার মূল আসামিকে ধরতে পুরনো চোরদের সহযোগিতা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন—সিসি ক্যামেরায় চোরকে দেখা গেছে। অথচ ওই ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার পরও কেউ তাকে চিনতে পারছে না। এ কারণে বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকে চুরির সঙ্গে জড়িত এমন চোরদের ধরে এনে তাদরে সহযোগিতায় মূল আসামিকে চিহ্নিত করা হবে।
ডিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক চোর আরেক চোরকে চেনে-জানে। অতীতেও এ পদ্ধতিতে অনেক জটিল মামলার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে। এই মামলার ক্ষেত্রেও ঢাকা মহানগরীর চোরদের ধরে এনে তাদের মাধ্যমেই সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ওই চোরকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
ডিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, এরই মধ্যে ২০ থেকে ২৫ জন চোরকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের কেউ সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ওই চোরকে চিনতে পারেনি। গত সপ্তাহে পুরান ঢাকার বংশাল এলাকা থেকে ইমন নামে এক চোরকে ধরে আনা হয়েছিল। সে এর আগে হাইকোর্ট এলাকায় ১৪ বছর ছিল। শেষে এক চুরির ঘটনায় জেলে গিয়ে আর হাইকোর্ট এলাকায় কাজে জড়িত হয়নি। আমরা প্রথমে তাকেই সন্দেহ করেছিলাম। তাকে খুঁজে পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। তবে সিসি ক্যামেরার ওই ছবির সঙ্গে তার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইমন সিসি ক্যামেরায় দেখা চোরকে চেনেন না বলে জানান। এরপর নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, উত্তরা, মিরপুর, আমিন বাজার, কদমতলী, শ্যামপুর, কেরানীগঞ্জ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, বছিলা, আটিবাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরদের ধরে এনে চোর শনাক্তের কাজ করা হয়েছে। এসব চোরের কেউ তাকে চিহ্নিত করতে পারেনি।
ডিবির আরেক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, সিআইডি ও পিবিআই ছায়া তদন্ত করছে। শাহবাগ থানা সিসি ক্যামেরার ওই ছবির সঙ্গে মিল রেখে এখন পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। এরপরও চোরের সন্ধান মেলেনি।
চোরকে অবশ্যই ধরে আইনের আওতায় আনা হবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন ডিবির এই কর্মকর্তা। এমনকি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা যে চারজন এখন জেলে আছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনকেও ছবির সঙ্গে মিল রেখে চেক করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার এসআই মনসুর আহাম্মেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিন্দুক চুরির মামলায় চার নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাদের কলরেকর্ড চেক করার কাজ চলছে। অপরিচিতদের অনেক কল লিস্ট পাওয়া গেছে। সেগুলো মনোযোগসহ শোনা হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় এনে মামলার তদন্তকাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, চোর অবশ্যই ধরা পড়বে।’
চোর দিয়ে চোর শনাক্তের কাজ চলছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এই কাজ থানা পুলিশের কেউ করেনি। অন্য কোনো সংস্থা করতে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
এদিকে, মামলার তদারক কর্মকর্তা রমনা জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এহসান ফেরদৌস বলেন, ‘হাইকোর্ট মাজারের সিন্দুক ভেঙে টাকা লুটের ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়া ব্যক্তিকে (নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি) ধরতে এরই মধ্যে রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে। তার ছবি গণমাধ্যমে দেওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন পাওয়া যাচ্ছে। যেখানেই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই পুলিশ ছুটে যাচ্ছে। সব ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ওই ছবি পাঠানো হয়েছে। ’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুলিশের সব ইউনিটসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছেও একই ছবি সরবরাহ করা হয়েছে। জড়িতদের ধরতে ডিএমপির পক্ষ থেকে সবার সহযোগিতা চেয়ে গত ১৬ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এতবড় চুরির ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি সম্ভব হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘কোনো কোনো মামলার ডিটেক্ট করা সহজেই হয়ে যায়। কিছু ঘটনা আছে, যেগুলোর দীর্ঘ তদন্তের প্রয়োজন হয়। মাজারের টাকা লুটের ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে না পারলেও তদন্ত কাজ চলছে। পুলিশ লেগে আছে। সময় লাগলেও নিশ্চয়ই জড়িতরা ধরা পড়বে।’
এদিকে রোববার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে হাইকোর্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাইকোর্ট মসজিদ, মাজার ও মাদরাসাসহ সিন্দুক পাহারায় চারজন নিরাপত্তাকর্মীকে (নাইট গার্ড) রাখা হয়েছে। তারা সারারাত পালাক্রমে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। কলাপসিবল গেটের তালাসহ সিন্দুকে নতুন তালা লাগানো হয়েছে।
এছাড়া কর্তৃপক্ষ নতুন করে সিসি ক্যামেরার সংখ্যাও বাড়িয়েছে। তবে সেখানে কথা বলার মতো দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রাতে হাইকোর্ট মাজারের ভেতরে থাকা ১২টি সিন্দুকের তালা ভেঙে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও বিদেশি মুদ্রা চুরি হয়। পরদিন টের পেয়ে পুলিশ মাজারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। তারা হলেন, শাহাজান মিয়া, আবদুর রাজ্জাক, মোতালেব হোসেন ও আলাউদ্দিন।
জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও গত ৪ জানুয়ারি শাহাজান, রাজ্জাক ও মোতালেবকে এবং ৭ জানুয়ারি আলাউদ্দিনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। ওই চার জন এখন কারাগারে।
সারাবাংলা/ইউজে/এমএনএইচ