বিশ্ব ইজতেমা এবার ৪ দিন
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২২:১৭
।।সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: বিশ্ব ইজতেমা এবার তিন দিনের পরিবর্তে চারদিন হবে বলে জানিয়েছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ইজতেমা বাস্তবায়নে দুই পক্ষকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম দুই দিন মাওলানা জোবায়ের ও পরের দুই দিন সৈয়দ ওয়াসীফুল ইসলামের ব্যবস্থাপনায় ইজতেমা পরিচালিত হবে। ফলে ইজতেমা চারদিনের করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ে ইজতেমা নিয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এবার ইজতেমায় যেন কোনো প্রকার গণ্ডগোল না হয়, সেজন্য উভয় পক্ষকেই বলা হয়েছে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনীও নামানো হতে পারে। দুই দিন করে উভয়ই ইজতেমার ব্যবস্থাপনা করলেও আখেরি মোনাজাত নিয়ে এখনো শঙ্কা কাটেনি। তাই তাবলিগ জামাতের মুরুব্বিদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে। আখেরি মোনাজাতের বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।’
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এবারের ইজতেমায় যেন বিদেশি অতিথিরা নির্বিঘ্নে আসতে পারেন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। অতিথিদের ভিসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা যেন না থাকে, তারা। দেশে আসার পর যেন সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে বসতে পারেন, সে ব্যাপারেও বলা হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, গত ২৪ জানুয়ারি তাবলিগ জামাতের বিবদমান দুই পক্ষের সঙ্গে ধর্ম মন্ত্রণালয় বৈঠক করে ১৫ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে, বুধবার (২৩ জানুয়ারি) দুপুরে তাবলিগের দুই পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। বৈঠক শেষে তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে মিটমাট হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে দুই পক্ষ মিলেই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করবে। ইজতেমার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মাওলানা সাদ আহমাদ কান্ধলভী ও মাওলানা জোবায়ের আহমেদের পক্ষের তাবলীগ জামাত নেতারা উপস্থিত ছিলেন। দুই দলের নেতৃত্ব দেন ওয়াসিকুল ইসলাম ও মাওলানা জোবায়ের। দুই দলেই ১৬ থেকে ১৭ জন করে সদস্য বৈঠকে অংশ নেন। সরকারের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ, ধর্ম সচিব মো. আনিছুর রহমান, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের প্রধান বেনজির আহমেদ ও আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, তাবলিগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালে। এরপর গত বছর এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। ঘটনা বিবরণে জানা যায়, তাবলিগ জামাতের মুরব্বি ভারতের মাওলানা মোহাম্মদ সা’দ কান্দালভির বক্তব্যের সূত্র ধরেই এ দ্বন্দ্বের শুরু।
সা’দ তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়। মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ডও এর মধ্যে পড়ে বলে মনে করেন তিনি। মাওলানা সা’দের এ বক্তব্যে ক্ষেপে ওঠে বিরোধী পক্ষ। দুই পক্ষের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষও হয়েছে। এর মধ্যে ১ ডিসেম্বরের সংঘর্ষে তাবলিগ জামাতের দু’জন নিহত হন। এ ঘটনায় দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে। এর মধ্যে জানুয়ারির ১৯ থেকে ২১ ও ২৬ থেকে ২৮ জানুয়ারি— দুই ধাপে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের ঘোষণা দেন সা’দবিরোধীরা। তবে এই সময়ে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের জন্য তুরাগ তীরের ময়দান ব্যবহার না করতে পুলিশ-প্রশাসনের দ্বারস্থ হন মাওলানা সা’দের অনুসারীরা। তবে কোনো পক্ষকেই তুরাগ ময়দান ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন।
এরও আগে, গত বছর বিশ্ব ইজতেমার প্রধান ইমাম মাওলানা সাদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ জামাতের অনুসারীরা। ওই সময় মাওলানা সা’দ দিল্লি থেকে এসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটকা পড়েন। ওই সময় বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে সা’দবিরোধীরা অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরে মাওলানা সাদকে সুরক্ষা দিয়ে ক্যান্টনমেন্টর ভেতর দিয়ে কাকরাইলে পৌঁছে দেয় পুলিশ। এ নিয়ে কয়েকদিন কাকরাইল মসজিদের আশেপাশে দুই পক্ষের অনুসারীদের সংঘর্ষ বাধে। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে মাওলানা সা’দকে দিল্লিতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এ ঘটনা নিয়ে প্রায় সারাবছরই দুই পক্ষের অনুসারীদের কোনো না কোনো ঝামেলা বেঁধেছে। কাকরাইল মসজিদে একপক্ষ আরেক পক্ষকে প্রবেশে বাধা দিয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে পুলিশ কখনো কখনো কাকরাইল মসজিদে দুই পক্ষের কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়নি।
এসব বিষয় নিয়ে গত বছরজুড়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে সা’দপন্থি, সা’দবিরোধী ও সরকারপক্ষের মধ্যে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে ভারতের দেওবন্দে এ নিয়ে তিন পক্ষের উপস্থিতিতে বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। এর মধ্যেই ১৭ জানুয়ারি দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানির সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের (সা’দপন্থী ও সা’দবিরোধী) সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কারও সঙ্গেই সম্পর্ক না রাখার ঘোষণা দেয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। সব মিলিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল বিশ্ব ইজতেমার এবারের আয়োজন।
এর মধ্যে গত সোমবার (২১ জানুয়ারি) বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনে সরকারের সহযোগিতা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও তাবলীগের সাথী মো. ইউনুছ মোল্লা। রিটে ধর্মমন্ত্রণালয়ের সচিব, উপসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবসহ তিন জনকে বিবাদী করা হয়। পরদিন মঙ্গলবার রিটের আংশিক শুনানি নেন বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ। ২৭ জানুয়ারি রিটের পরবর্তী তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। রিট শুনানিতে আদালত বলেন, আপনাদের তো আল্লাহর ভয়ে একনিষ্ঠ হয়ে থাকার কথা। আল্লাহকে ভয় করে নরম মন নিয়ে একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিন। নিজেদের মধ্যে মারামারি করবেন, আর ইজতেমা পালনের জন্য আদালতে রিট করবেন, এটা লজ্জাজনক।
সারাবাংলা/ইউজে/ এমএনএইচ