ব্রি’র জিন ব্যাংকে সুরক্ষিত সাড়ে ৮ হাজার ধানের জাত
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১০:১৪
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
গাজীপুর থেকে ফিরে: বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় ধানের সব জাত সংরক্ষিত আছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) জিন ব্যাংকে। দেশের বিজ্ঞানীদের সদ্য উদ্ভাবিত জাতের সংরক্ষণাগারও এটি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আনা জাতও সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ব্যাংকটিতে দেশি-বিদেশি প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ধানের জাত সংরক্ষণ করা রয়েছে। ব্রি’র বিজ্ঞানীরা বলছেন, তিন ধাপে সংরক্ষণ করা এসব জাত টিকে থাকবে বছরের পর বছর। ফলে ফসলের মাঠ থেকে কোনো জাত হারিয়ে গেলেও বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা নেই। জাতগুলো আর্ন্তজাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) ও নরওয়েতে অবস্থিত গ্লোবাল সিড ব্যাংকেও রক্ষিত আছে।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূল ফটক পেরিয়ে বাহারী ফুলে সজ্জিত রাস্তা ধরে এগুলোই ব্রি’র প্রশাসনিক ভবন। পশ্চিম দিকে এগিয়ে বামের রাস্তায় আরেকটু দূরে চোখে পড়বে লাল রাঙের ভবন- ‘রাইস জিন ব্যাংক অ্যান্ড সিড ল্যাবরেটরি’। এলাকাটি সংরক্ষিত হওয়ায় জিন ব্যাংকে সর্বসাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে অনুমতি নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ভেতেরে প্রবেশ করতে পারেন। জিন ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে, এক কোণায় লেখা রয়েছে ৮ হাজার ৪শ’ জার্মপ্লাজম রক্ষিত রয়েছে সেন্টারটিতে। অন্য একটি স্থানে লেখা রয়েছে, ‘রাইস জেনেটিক রিসোর্সেস অব বাংলাদেশ, প্লিজ সেইভ আস’। তবে প্লাস্টিকের কৌটায় পুরোনো কিছু জাতও প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। এখানে বিআর শাহীবালাম, নয়াপাইজাম, রহমত, দিশারী, বিআর-১৪ (গাজী), প্রগতি, মুক্তাসহ ব্রি’ ধানের বিভিন্ন জাত চোখে পড়বে।
বিজ্ঞানীরা জানান, প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সব ধানের সংগ্রহশালা এটি। দেশের নানা অঞ্চলের এক সময়ের জনপ্রিয় বিভিন্ন মৌসুমের সব ধরনের ধানের জাতই রক্ষিত আছে সেন্টারটিতে। আউশের মধ্যে কটকতারা, সূর্যমুখী, চারনক, পুখী, আতলাই, পানবিড়া, ধারিয়াল, কুমারী ও বাইপাসের মধ্যে পুরোনো জাত রয়েছে জিন ব্যংকে। আমনের মধ্যে রয়েছে, কার্তিকশিন্নী, মালতি, বিরই, গাঞ্জা, চাপলাশ, গাজীয়া, ইন্দ্র শাইল, কার্তিক শাইল ও সরিষাকানির মতো পুরোনো জাত। এছাড়াও আছে লতিশাইল, জিংগাশাইল, তিলককাচারী, দুধসর, চিংড়িঘুষি, খিড়াইঝুলি ও বাসফুলের মতো এক সময়ের চেনা ধানের জাত। টোপাবোরো, খৈয়াবোরো, বনজিরা ও পশুশাইলের মতো বোরো মৌসুমের পুরোনো ধানের জাতও রয়েছে সংরক্ষিত।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের জিন ব্যাংকে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ধানের জাত রয়েছে। নিত্য নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত এসব জার্মপ্লাজম ব্যবহার হয়। বলা চলে, ধান গবেষণায় এটি আমাদের গবেষণার অন্যতম রসদ।
তিনি বলেন, নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে কোনো একটি জাতের কী বৈশিষ্ট্য, আমরা কোন বৈশিষ্ট্যের জাত উদ্ভাবন করতে চাই, সেই অনুযায়ী- একটি জাতের সঙ্গে অন্য একটি জাতের ক্রস করা হয়। এভাবেই নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবন হচ্ছে।
সারাবাংলার এক প্রশ্নের জবাবে ব্রি’র মহাপরিচালক বলেন, নতুন করে আর কোনো জাত হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা নেই। বরং জিন ব্যাংকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জার্মপ্লাজম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। আর এভাবেই নতুন নতুন জাতের প্রসার ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা জানান, জিন ব্যাংক হচ্ছে জেনেটিক তথ্য বা দেশের ভূ-সম্ভুত প্রাকৃতিক বীজ সম্পদ। যদি কোনো কারণে মাঠ থেকে কোনো শস্য বা জাত হারিয়ে যায়, তাহলে জিন ব্যাংকে রক্ষিত নমুনা থেকে তা ফিরে পাওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রয়োজন অনুযায়ী, এ সমস্ত জাতের ব্যবহার ও আদান-প্রদান হয়ে থাকে। নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে রক্ষিত জাতের জিন বা বৈশিষ্ট্য নেওয়া হয়।
ব্রি’র তথ্যমতে, জিন ব্যাংকে সংরক্ষিত ধানের জাতের নমুনা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি- এই তিন ধাপে সংরক্ষণ করা হয়। স্বল্প মেয়াদে বীজ সংরক্ষিত থাকে ৩ থেকে ৫ বছর। মধ্য মেয়াদে ১৫ থেকে ২০ বছর। আর দীর্ঘ মেয়াদে ৫০ থেকে ১শ’ বছর। কিন্তু ১শ’ বছর অতিক্রান্ত হলেও কোনো জাত হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা নেই। কারণ জিন ব্যাংকের প্রক্রিয়াটি চক্রাকার। স্বল্প মেয়াদে সংরক্ষিত কোনো বীজ ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে মধ্য মেয়াদে নিয়ে যাওয়া হয়। আর মধ্যমেয়াদী সময় অতিক্রান্ত হলে তা সংরক্ষণের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি সময়ের চেম্বারে প্রবেশ করানো হয়। দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষিত কোনো বীজ নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে বা তা বের করার প্রয়োজন হলে প্রথমে মধ্য মেয়াদের চেম্বারে নিয়ে আসা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর তা আবার আনা হয় স্বল্প মেয়াদের সংরক্ষণ স্থলে। স্বল্প মেয়াদে সংরক্ষিত বীজ পুনঃউৎপাদন শর্তে বিজ্ঞানারী গবেষণা কাজে ব্যবহার করেন। সেখান থেকে তা আবার নেওয়া হয় স্বল্প মেয়াদ চেম্বারে। পরে আবার একই চক্রাকারে দীর্ঘকাল ধরে জাতটি সংরক্ষণ করা হয়।
সারাবাংলাকে ব্রি’র ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আরমিন ভূঞা বলেন, কোনো একটি জার্মপ্লাজম ১শ’ বছর পর্যন্তই ব্যবহার করা যাবে, এমন নয়। জিন ব্যাংকে একটি সাইকেল মেইনটেন করা হয়। ৩ বছর পর পর কোনো একটি জাত মাঠে দেওয়া হয়। জাতগুলো নিয়মিত চেকআপ করা হয়। রুটিন ফলো আপের মধ্যে রাখা হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্ব থেকেই জাত সংগ্রহ করা হয়।
তিনি বলেন, জাত সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রথমে ব্রি’র ক্যাটালগ দেখা হয়। আমরা যে জাতটি সংরক্ষণ করতে চাই তার পাসপোর্ট ডাটা (প্রাথমিক তথ্য) নিয়ে আসি। যদি জাতটির বৈশিষ্ট্য ব্যাংকে রক্ষিত জাতগুলো থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হয়, তবেই নতুন জাতটি সংরক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ সংরক্ষিত নতুন জাতটি হবে পুরো ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের।
আরমিন আরও বলেন, আমাদের জিন ব্যাংকটি শতভাগ নিরাপদ। ২৪ ঘণ্টাই এখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্যাংকটি স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে সংরক্ষিত কোনো বীজ নষ্ট হওয়ারও সুযোগ নেই।
কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন তার লেখা ‘ধান, ধ্যান ও বিজ্ঞান’ বইয়ে জিন ব্যাংকের বিস্তর তথ্য তুলে ধরেছেন। বইটিতে তিনি লিখেছেন, ব্রি’র জন্মলগ্ন (১৯৭০) থেকেই সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ধানের জাতগুলো সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। স্বল্প মেয়াদি রাইস জিন ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। আর ২০০৭ সালে দীর্ঘ মেয়াদি সংরক্ষণ পদ্ধতি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে জিন ব্যাংকটি আধুনিকতার পূর্ণতা পায়।
মোমিনের তথ্যমতে, ব্রি রাইস জিন ব্যাংকে দেশের সব এলাকার বীজ সংরক্ষণ করা হয় সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। সঠিক তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা এবং আলোকমাত্রা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যাতে দীর্ঘ মেয়াদে এই সংরক্ষিত বীজ জীবিত অবস্থায় (অংকুরোদগমক্ষম) থাকবে। ফলে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সংরক্ষিত থাকায় আদি গুণাগুণ অক্ষুণ্ন বা অক্ষত রেখে এখনো টিকে আছে দেশি ধানের জাতগুলো। শত বছর আগে বিশেষ কোন জাতের কী বৈশিষ্ট্যে বা বিশেষত্ব ছিল তাও লিপিবদ্ধ আছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাইস জিন ব্যাংকে।
বীজ সংরক্ষণের তিনটি প্রক্রিয়া উল্লেখ করে মোমিন তার বইয়ে লিখেছেন, জিন ব্যাংকে তিন ধাপে সংরক্ষণ করা হয় বীজ। স্বল্প মেয়াদে কাঁচের তৈরি জারে ২০-২২ ডিগ্রি সেলাসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৫০-৬০ ভাগ আপেক্ষিক আদ্রতায় বীজগুলোকে সিল করা হয়। এখানে বীজের আদ্রতা রাখা হয় ১০ থেকে ১২ শতাংশ। স্বল্প মেয়াদে বীজগুলো সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। মধ্য মেয়াদে সিলিকা জেলসহ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকে ০-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বীজগুলোকে সিল করে রাখা হয়। এতে বীজের আদ্রতা থাকে ৮-১০ শতাংশ। এখানে বীজগুলো সাধারণত ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত রাখা হয়। নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে বীজের গুণাবলী। তারপর এগুলো স্থানান্তর করা হয় দীর্ঘ মেয়াদি সংরক্ষণাগারে। দীর্ঘ মেয়াদি রাইস জার্মপ্লাজমগুলো থাকে মাইনাস ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। যেগুলো সাধারণত ৫০ থেকে ১শ’ বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। এভাবে তিন ধাপে চক্রাকারে সংরক্ষিত থাকে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা। বিভিন্ন ধাপে অভিযোজনের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ এই তিনটি ধাপে চক্রাকারে স্থানান্তর ও পুনঃউৎপাদন করা হয়।
মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাবেক মহাপরিচালক ও ধান গবেষক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, এক সময় ৩০ হাজার ধানের জাত ছিল গোটা বাংলায়। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ বিজ্ঞানী ড. হেক্টরের মতে ধানের জাত ছিল ১৮ হাজার। পরে ব্রি’র জরিপ অনুসারে, ধানের ১২ হাজার ৪৮৭টি ধানের নাম সংগ্রহ করা হয়। তখন কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বৈত নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এ তালিকায়। তবে যতটা সম্ভব দ্বৈত নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। ওই নামগুলো থেকে ১২ হাজার জাতের ধান লিপিবদ্ধ করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আধুনিক পদ্ধতি আসার পর কৃষকরা পুরোনো জাতের আবাদ বাদ দিতে শুরু করে। বর্তমানে ব্রি’র জিন ব্যাংকে ৭ হাজারের বেশি দেশি ধানের জাত সংরক্ষিত আছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকটিতে জাতের পরিমাণ ৮ হাজারের উপরে।
সারাবাংলার এক প্রশ্নের জবাবে এই ধান গবেষক বলেন, ২০০৫ সালের দিকেও ধারণা করা হতো দেশে হাজার খানেক জাতের ধান আবাদ হচ্ছে। কিন্তু আমার ধারণা বর্তমানে হয়তো সর্বোচ্চ ৫শ’ থেকে ৬শ’ জাতের ধানের আবাদ হচ্ছে। আর উচ্চ ফলনের প্রয়োজনেই কৃষকরা পুরোনো জাতের ধান চাষ থেকে সরে এসেছেন।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এটি