Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুলিশ ক্যাডারে প্রথম, এবারে রাষ্ট্রপতি পদক


৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১১:১০

।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। যোগ দেওয়ার পর পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণেও হয়েছিলেন সেরা, পেয়েছিলেন বেস্ট প্রবিশনারি অ্যাওয়ার্ড, বেস্ট একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্সেও হয়েছিলেন প্রথম। পেশাগত দক্ষতার জন্য তিনি যে আরও অনেক পুরস্কারই পাবেন, সেটিও ছিল অনুমিত। সর্বশেষ সাহসিকতা ও দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে পদক বিতরণ করেছেন, তাতেও তাই স্বাভাবিকভাবেই ছিল তার নাম। পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)।

বিজ্ঞাপন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পিপিএম পদক গ্রহণ করা এই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হিসেবে কর্মরত তিনি। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা গেছে, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ কাজ ও অসীম সাহসিকতার জন্যই তাকে এই পদক দেওয়া হয়েছে।

জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এমন সাফল্য আর স্বীকৃতি একের পর এক ধরা দিলেও গোলাম সাকলায়েনের জীবনের উত্থানের পথ একটা মসৃণ ছিল না। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় পদ্মার পাড়ে মোক্তারপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল সংগ্রাম মুখর। মেধা আর পরিশ্রমে অবশ্য সব প্রতিকূলতা জয় করেই আজকের এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছেন তিনি।

পিপিএম পদক পাওয়ার পর সারাবাংলার কাছে গোলাম সাকলায়েন তুলে ধরেছেন তার জীবনের গল্প। আজকের সাফল্যের পেছনে যাদের অবদান রয়েছে, বলেছেন তাদের কথাও। জানালেন অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর থেকেই ভালো ছাত্রের তকমা লেগে যায় গায়ে। ২০০১ সালে সারদা সরকারি পাইলট একাডেমি হাই স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪ দশমিক ৬৩ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ ৫ না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিল। কিন্তু তার গ্রামের জন্য এটিই ছিল অভাবনীয় ফল। পরে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে।

বিজ্ঞাপন

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে সাকলায়েনকে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সাকলায়েনের বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মেরুদণ্ডের সমস্যা থাকায় চিকিৎসার পেছনে খরচ হতো অনেক অর্থ। সাকলায়েনকে তাই রাজশাহীতে মেসে রেখে পড়ানোর সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। প্রতিদিন সাইকেলে করে চারঘাট থেকে রাজশাহীতে এসে কলেজ করতেন।

সাকলায়েন বলেন, আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। এলাকায় প্রাইভেট পড়ারও প্রচলন ছিল না। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাস আয়ত্তে আনতে পারছিলাম না। বিশেষ করে গণিত একদমই দুর্বোধ্য ছিল আমার কাছে। পরে পরীক্ষার আগে একমাস গণিত প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন নজরুল স্যার। সেটুকু ভরসা করেই এইচএসসি পাস করেছি। স্যার না পড়ালে হয়তো এইচএসসিতে পাসই করতে পারতাম না। স্যারের এই অবদানের সঙ্গে তাই কোনোকিছুরই তুলনা হয় না।

কেবল ক্লাস করা নয়, এইচএসসি পরীক্ষাও সাকলায়েনকে দিতে হয়েছে চারঘাট থেকেই। এত সব মিলিয়ে এইচএসসি’র ফলটাও আশানুরূপ ছিল না, পেয়েছিলেন জিপিএ ৩ দশমিক ৮০। মা-বাবা কিছু না বললেও সাকলায়েন নিজেই মনোকষ্টে ছিলেন এই ফলে। আবার এই ফল নিয়ে বুয়েট-মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কথাও ভাবেননি। পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যাওয়ার মতো অবস্থা সেসময়।

এর মধ্যে সাকলায়েন জানতে পারেন, এইচএসসির পর সামরিক বাহিনীতে কমিশন পদের জন্য আবেদন করা যায়। করলেন সেটাও। সেখানে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন ৫৯ লং কোর্সে। কিন্তু দুরন্ত শৈশব-কৈশোর কাটানো সাকলায়েনের কাছে সামরিক বাহিনীর নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে নেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ছিল। বন্ধু হয়ে পাশে থাকা মা’কে সে কথা জানালে তিনিই ছেলেকে ফিরিয়ে আনেন মিলিটারি একাডেমি থেকে। ছেলেও ফিরে যায় দুরন্ত জীবনে। একটা বছর কেটে যায় হেলাফেলায়।

এর মধ্যে বন্ধুরা সবাই যে যার মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলে টনক নড়ে সাকলায়েনের। প্রস্তুতি নিয়ে অংশ নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। ১৪টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ১৩টিতেই উত্তীর্ণ হলেও নিজের পছন্দের ইংরেজি বিভাগেই অকৃতকার্য হন। পরে সবার পরামর্শে ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে, ভর্তি পরীক্ষায় এ বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। ক্লাস শুরু করেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে সাধারণ জ্ঞানের শিক্ষক হিসেবেও যোগ দেন। এসময় শুরু করেন টিউশনি। নিজে কখনও প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় বছর পড়িয়েছেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের সন্তানদের, বিনামূল্যে কিনে দিয়েছেন বই। তার পড়ানো প্রায় ৫০০ ছেলে-মেয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।

সাকলায়েন চতুর্থ বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল পাওয়ার আগেই ‘অবতীর্ণ’ বা ‘অ্যাপিয়ার্ড’ হিসেবে আবেদন করেন ৩০তম বিসিএসে। সাকলায়েন বলেন, চয়েজ ফর্ম নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম, কিছু বুঝতাম না। অর্থনীতি বিভাগের এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। তিনি জানান, সবচেয়ে ভালো ফরেন ক্যাডার। কিন্তু সেখানে চান্স পেতে হলে সুদর্শন, স্মার্ট ও ইংরেজিতে ভালো হতে হবে। ভেবে দেখলাম, এর কোনোটিই আমার নেই। পরে কিছু না বুঝেই প্রথম চয়েজ দিয়েছিলাম পুলিশ ক্যাডার। ইংরেজি ভালো না বলতে পারলেও বেসিকটা ভালো ছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে গণিত নিয়ে ঝামেলা হলেও গণিতের বেসিকটাও ভালো ছিল। এর মধ্যে নিজে কোচিংয়ে পড়াতাম সাধারণ জ্ঞান। তাই বাংলা আর বিজ্ঞানটা বেশি বেশি পড়লাম। প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেও টিকে গেলাম। পরে আর আটকাতে হয়নি কোনো ধাপেই।

এদিকে, ৩০তম বিসিএসের কার্যক্রম যখন চলছে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরীক্ষায় প্রথম হন সাকলায়েন। একইসঙ্গে পরীক্ষা দিয়ে সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবেও টিকে যান, যোগ দেন সেই চাকরিতেই। পোস্টিং হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সে অবস্থাতেই অংশ নেন ৩০তম বিসিএসের ভাইভা পরীক্ষায়। কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন সে পরীক্ষাতেও।

৩০তম বিসিএসের ফলপ্রকাশের দিন ব্যস্ত ছিলেন গোলাম সাকলায়েন। তিনি বলেন, এক কাজিন জানালো বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয়েছে। অফিসের কম্পিউটারে বারবার চেষ্টা করেও পিএসসি’র (সরকারি কর্ম কমিশন) ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারিনি। অনেক চেষ্টার পর ঢুকলাম, বিসিএসের ফলও পেলাম। শুরুতেই শিক্ষা ক্যাডারে চেক করে রোল পেলাম না। বেশ হতাশ হয়ে গেলাম। মনে হলো, বিসিএসটা হলো নাং! আরও দুয়েকটা ক্যাডার দেখে পুলিশ ক্যাডারে ঢুকতেই দেখি শুরুতে আমার রোল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি। এর মধ্যেই ফোন করি মা’কে। শুনেই কেঁদে ফেলেন। মা সবসময় বলতেন তুমি বিসিএসে প্রথম হবে। শেষ পর্যন্ত মায়ের সেই কথাই সত্যি হলো।

এরপর শুরু সারদা পুলিশ একাডেমিতে বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ। এবার অবশ্য বাড়ির পাশে হওয়ায় আর পালাতে হয়নি। তাই মন দিয়েই নিয়েছেন প্রশিক্ষণ, মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তাতে হয়েছেন প্রথম। বেস্ট প্রবেশনারি অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে পরে পেয়েছেন বেস্ট একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড। বিভাগের সবার পরামর্শে পেশাগত দক্ষতার তাত্ত্বিক জ্ঞান বাড়িয়ে নিতেই একসময় ফের ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুলিশ সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে। এবারে তাতেও প্রথম হন তিনি।

প্রশিক্ষণ শেষে নওগাঁতে প্রথম পোস্টিং গোলাম সাকলায়েনের। পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে যে সম্মান পেয়েছেন, তাতে বেড়ে যায় কর্মস্পৃহা। তবে মা-বাবা কাছে না থাকায় তাদের দেখতে ছুটির অপেক্ষাই করতেন সবচেয়ে বেশি।

গোলাম সাকলায়েন মনে করেন, পুলিশ সদস্যদের পেশাটাই এমন যে সবসময়ই নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। তিনি বলেন, আমাকেও প্রতিনিয়তই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কপিল বাড়ৈ হত্যাকাণ্ডের আসামি গ্রেফতার করা। ওই আসামিকে ধরতে যেতে হয়েছিল সিলেটের তামাবিলে। সেখানে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে ছদ্মবেশ নিয়ে নামতে হয়েছিল হাওরে। তবে শেষ পর্যন্ত আসামিকে ধরতে পারলে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ চাকরিপ্রার্থীদের জন্যও দিকনির্দেশনা দিলেন। বলেন, ‘প্রতিটি বিষয়ের জন্য আগে থেকে কিছু টপিক ঠিক করে নিতে হবে। তারপর সে বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। এক্ষেত্রে ছোট ছোট চিরকুট তৈরি করা যেতে পারে। সুযোগ পেলেই একটু চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। যে বিষয়টিতে আপনি বেশি দক্ষ, সে বিষয়ে সময় বেশি দিলে বেশি নম্বর পাওয়া যায়। তাই নিজের দক্ষতার জায়গাতেই জোর দিতে হবে বেশি।’ মৌখিক পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, ভাইভা বোর্ডে আচরণে হতে হবে বিনীত ও মার্জিত। সব উত্তরই দিতে হবে ইতিবাচকভাবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

চীনের একটি প্রবাদ রয়েছে— ‘হার্ডওয়ার্ক সাপোর্টেড বাই গুড ইনটেনশন মেকস মিরাকল’। এই প্রবাদটিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছেন গোলাম সাকলায়েন শিথিল। এই প্রবাদের মতোই তিনিও বিশ্বাস করেন, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করলে সাফল্য আসবেই। সে অনুযায়ীই পথ চলছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা।

সারাবাংলা/ইউজে/টিআর

গোলাম সাকলায়েন শিথিল পুলিশ কর্মকর্তা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর