ভাসকুলার সার্জন স্বল্পতায় বাড়ছে রোগীদের দুর্ভোগ
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:০৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে রক্তনালীর রোগে আক্রান্তরা মারা যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া দেশে ভাসকুলার সার্জন বা রক্তনালী চিকিৎসকের সংখ্যা হাতেগোনা। দেশের সব হাসপাতালে এই সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়-সংখ্যক বিভাগ ও বেডও নেই। ফলে রক্তনালীর রোগীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সারাদেশে এই চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য করা না গেলে হাত ও পা হারানো মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব সরকারকে নজর দিতে হবে।
জানা গেছে, দেশে ভাসকুলার সার্জন রয়েছেন মাত্র ১৮ জন। এরমধ্যে পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক তিন জন। চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। কিন্তু এসব হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভাসকুলার সার্জারিতে রয়েছে ২৬টি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে মাত্র চারটি বেড।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রক্তনালীর চিকিৎসায় দেশে প্রতি এক কোটি মানুষের জন্য রয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ না জানার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভাসকুলার সার্জারি নামটিই অনেকের কাছে অপরিচিত। তারা জানালেন, যেকোনো আঘাতজনিত কারণে ধমনী অথবা শিরার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত হলে যে অস্ত্রোপচার করতে হয়, তাকেই ভাসকুলার সার্জারি বলা হয়। যে চিকিৎসক এই অস্ত্রোপচার করেন তাকেই ভাসকুলার সার্জন বলা হয়ে থাকে।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে এই হাসপাতালে ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় পাঁচ হাজার রোগী। অস্ত্রোপচার হয়েছে প্রায় ৭৯৩ জনের। প্রতিদিন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী।
চিকিৎসকরা বলছেন, দেশে এখন মৃত্যুর অন্যতম কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। এমনকী, এসব দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সেই সঙ্গে রয়েছে ছিনতাইকারীর আক্রমণ। আর ছিনতাইকারীর আক্রমণের শিকার হয়ে আসা রোগীর সংখ্যাও কম নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতসহ নানা ধরনের দুর্ঘটনায় অনেক সময় ধমনী বা শিরা কেটে যায়। তখন হাত ও পায়ের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে এসব রোগীর চিকিৎসা দরকার হয় জরুরিভিত্তিতে।
এছাড়া স্ট্রোকের রোগীদের রক্তনালীতে থাকা টিউমার না ধরা পড়লে সে টিউমার ফেটে রক্তক্ষরণ হতে পারে। রক্তনালী কেটে কিংবা ফেটে যাওয়ার পর যদি ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে চিকিৎসা শুরু না করা যায়, তাহলে হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ বিভাগীয় ও জেলা হাসপাতালগুলোয় ভাসকুলার সার্জন নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক সারাবাংলাকে জানান, দেশের রাস্তাঘাটে দেখা হাত-পা হারানো অধিকাংশ ভিক্ষুক ভাসকুলার সার্জারির রোগী। তাদের হাত-পায়ের রক্তনালী ব্লক হয়ে আছে। অথচ এ রোগের চিকিৎসা রয়েছে। মানুষ ভাসকুলার সার্জারির বিষয়ে একেবারেই জানে না। জানেন না অনেক চিকিৎসকও।
চিকিৎসকরা বলছেন, হার্টে যেমন রিং পরানোর সুযোগ রয়েছে, তেমনি সুযোগ রয়েছে পায়ে রিং পরানোরও। হার্টে যেমন বাইপাস সার্জারি হয়, তেমনি পায়েও বাইপাস করা যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো বটেই অনেক চিকিৎসকও এ বিষয়টি জানেন না।
জানতে চাইলে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এসএমজি সাকলায়েন রাসেল সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিপ ভেইন থ্রোম্বাসিস বা গভীর শিরায় ব্লক হতে পারে, এটা নিয়ে মানুষ একেবারেই সচেতন নয়। আর এ না জানার কারণে যখন কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যান, তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করেন। বাংলাদেশে এ ধরনের অসংখ্য রোগী রয়েছে। কিন্তু আমরা জানিই না, এর জন্য কোথায় যেতে হবে, কোন চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আর তখনই সাধারণত এ রোগীরা অপচিকিৎসার শিকার হন। এটা অভিজ্ঞতায় দেখেছি।’
ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, “সাধারণত সড়ক দুর্ঘটনায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মানুষ মারা যায়। অথচ ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলে পরিচিত ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে যদি কেটে যাওয়া রক্তনালী জোড়া না দেওয়া যায়, তাহলে আর হাত-পা রক্ষা করা যায় না। কিন্তু আমরা বিষয়টি নিয়ে খুব একটা সচেতন নই।”
চিকিৎসাও রাজধানীকেন্দ্রিক ডা. সাকলায়েন রাসেল বলেন, ‘এটা প্রধান সমস্যা। চিকিৎসকের সংখ্যাও হাতেগোনা। তাই যারা এমবিবিএস পাস করেন, যারা এফসিপিএস ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাদেরও যদি তিন মাসের জন্য ভাসকুলার সার্জারি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে হাসপাতালগুলোতে পদায়ন করা যায়, তাহলে একদিকে মানুষের ভোগান্তি যেমন কমবে, তেমনি চিকিৎসকরাও এ বিষয় সচেতন হবেন।’
একই ধরনের কথা বললেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসকুলার সার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই দেশে রক্তনালীতে ব্লকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা থাকলেও চিকিৎসা ছিল না সেভাবে। অনেকে সঠিক চিকিৎসা পেতেনই না। কারণ, এ চিকিৎসাসেবা কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক এবং শয্যাসংখ্যাও খুব অপ্রতুল হাসপাতালগুলোতে।’
ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এই রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষ সচেতন না হওয়ায় তারা মেডিসিন, অর্থোপেডিকস, চর্ম রোগ; এমনকী হাতুড়ে চিকিৎসক, কবিরাজের কাছেও যান। কিন্তু তাতে করে রোগীরা অপচিকিৎসার শিকার হয়ে যেমন করে নিজের ক্ষতি করছেন, তেমনি সময়ের অপব্যবহার হচ্ছে। যখন এরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাছে আসছেন, ততদিনে কিছুই করার থাকে না।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘সরকারের কাছে আবেদন ভাসকুলার সার্জারি বিভাগ বিষয়ে যেন নজর দেওয়া হয়। এ বিষয়ে যেন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানো হয়। দেশের সব বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে এ বিষয়ে চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ
চিকিৎসক সংকট ভাসকুলার সার্জন ভাসকুলার সার্জারি রক্তনালী চিকিৎসক