‘পাক সেনাদের নির্যাতনের ইতিহাস মুছতে বানানো হয়েছিল জাদুঘর’
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৯:১১
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ইতিহাস প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করতেই চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সার্কিট হাউজকে ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’ বানানো হয়েছিল— এমন অভিযোগ করেছেন এই কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে সরব মুক্তিযোদ্ধা-সাংবাদিক পংকজ দস্তিদার। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানিদের এই নির্যাতনের চিহ্ন মুছে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ একাত্তরের রণাঙ্গনের সামনের সারির এই মুক্তিযোদ্ধার।
সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের নামে গড়ে তোলা এই ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘরকে’ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি জাদুঘরের রূপান্তরের জন্য মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠকে প্রস্তাব তুলেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এই প্রস্তাব নিয়ে চট্টগ্রামে চলছে ব্যাপক আলোচনা। সরব হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সারাবাংলা’র সঙ্গে কথা বলেছেন পংকজ দস্তিদার।
বয়স সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছুনো এই সাংবাদিক বলেন, চট্টগ্রাম শহরের কাজির দেউড়ির মোড়ের ভবনটি ব্রিটিশদের স্থাপনা ছিল। ব্রিটিশ সরকার ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চট্টগ্রামে এলে এই ভবনে থাকতেন। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা চট্টগ্রামে এলে এই সার্কিট হাউজ ব্যবহার করতেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এর ইতিহাস পাল্টে যায়।
স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া পংকজ দস্তিদার পুরনো সেই সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের বিবরণ দেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি সেনারা এই সার্কিট হাউজকে তাদের ক্যাম্প বানিয়ে ফেলে। সেটি ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে কত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী সাধারণ বাঙালিদের ধরে সেই ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়েছিল, তার কোনো হিসেব নেই।
‘আমাদের রাউজানের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, কিরণলাল আচার্য্য। ১৯৭১ সালে দুর্গাপূজার একদিন কি দুই দিন পর, অর্থাৎ অক্টোবর মাসে তার বাবাসহ ১০-১১ জনকে রাউজানের কদলপুর গ্রাম থেকে ধরে শহরে জেলখানায় নিয়ে আসা হয়। তাদের অপরাধ, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ছিলেন। কয়েকদিন জেলখানায় থাকার পর তাদের সেই সার্কিট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। দুই মাস ধরে তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। ডিসেম্বরের ১৩-১৪ তারিখের দিকে, যখন পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন সার্কিট হাউজের নিয়ন্ত্রণকারী সেনা অফিসার পালিয়ে যাওয়ার আগে নির্দেশ দেন, তাদের যেন জেলখানায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী তাদের জেলখানায় ফেরত নেওয়া হয়েছিল এবং ১৬ ডিসেম্বরের পর তারা মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে তারা নির্যাতনের বিবরণ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, সেই ক্যাম্পে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। আর কয়েকদিন সময় পেলে তাদের মেরে ফেলা হতো। তাদের চোখের সামনে অনেককে হত্যা করতে তারা দেখেছেন।’
পংকজ দস্তিদার বলেন, ‘সার্কিট হাউজটিকে টর্চার ক্যাম্প হিসেবেই পাকিস্তানি সেনারা ব্যবহার করেছিলেন। কুখ্যাত রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরী সেই ক্যাম্পে বসে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের বিচার করতেন। তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও সেখানে নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে ইলেকট্রিক চেয়ার ছিল। সেখানে বসিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হতো। সার্কিট হাউজের পেছনে মাটির চালার ঘরের ভেতরে একটি বিশাল গর্ত ছিল। মেরে সেখানে পুঁতে ফেলা হতো। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধারা গিয়ে সেই ক্যাম্প দখল করেছিলেন এবং সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।’
তবে মুক্তিযুদ্ধের পরও সেটি সার্কিট হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন প্রথম চট্টগ্রাম সফরে আসেন, তখন সেখানে উঠেছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে সেখানে হত্যা করা হয়। এরপর সেটি আর সার্কিট হাউজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। তবে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শুরু থেকেই সেটিকে পাকিস্তানিদের টর্চার সেল হিসেবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের দাবি করে আসছিলাম।’
জিয়া স্মৃতি জাদুঘর বানানোর ইতিহাস তুলে ধরে পংকজ দস্তিদার বলেন, ‘স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হলেন। এরপর হুট করে একদিন শুনতে পাই, সার্কিট হাউজটিকে জাদুঘর বানানো হচ্ছে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, কাজী ইনামুল হক দানু, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাহবুবুল আলমসহ অনেকেই এর প্রতিবাদ করেন। তবে সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ফোরামে এর প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন।’
‘এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৮ সালে আবার এসেছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বারবার এই দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সর্বশেষ আমরা গত রোববার চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসি। উপমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই প্রস্তাব তোলেন। এতে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা এবং সেসময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাদের পরিবার আশার আলো দেখছি,’— বলেন তিনি।
জিয়া স্মৃতি জাদুঘর বানানোর নেপথ্যে সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত ছিল মন্তব্য করে পংকজ দস্তিদার বলেন, ‘কেউ যদি মনে করেন, বেগম খালেদা জিয়ার সরকার পাকিস্তানিদের এই টর্চার সেলকে এমনি এমনি জিয়া স্মৃতি জাদুঘর করেছে, তাহলে ভুল হবে। কারণ, সেখানে জিয়ার মৃত্যু ছাড়া তার আর কোনো স্মৃতি ছিল না। সুতরাং এটা ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নানাভাবে বিকৃত করেছে। সেই ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস আড়াল করতে সেটিকে জাদুঘর বানিয়েছিল। বাস্তবে সেটিকে নিষিদ্ধ এলাকা করে ফেলেছিল। কারণ সেখানে জিয়াউর রহমানের দুয়েকজন ভক্ত ছাড়া কেউই যান না।’
জীবনের শেষ বেলায় পৌঁছানো এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের কাছে সত্যিকারের ইতিহাস উন্মুক্ত করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। ইতিহাস অবারিত করে দেওয়া হোক। এটা আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছি, আমাদের দায়। এটা ইতিহাসেরও দায়।’
১৯৫০ সালের ১০ এপ্রিল চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও গ্রামে জন্ম পংকজ দস্তিদারের। বাবা মৃত প্রসন্ন কুমার দস্তিদার, মা মৃত সুধাবিনী দস্তিদার। বেড়ে উঠেছেন পটিয়ার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। ছাত্রজীবনেই যুক্ত হন ছাত্র রাজনীতিতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুই বছর আগে কক্সবাজারের চকরিয়ার বড়ইতলী হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরি নেন। স্বাধীন বাংলাদেশে যোগ দেন সাংবাদিকতায়। বর্তমানে তিনি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে কর্মরত আছেন। অতীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নেও।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর