‘আজ ফাগুনের আগুন লাগে পলাশে-শিমুলে’
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:২০
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: সকালের স্নিগ্ধ বাতাস। হালকা ঠাণ্ডার অনুভূতি। আশপাশের গাছগাছালি ছেয়ে আছে ফুলে। নতুন গজানো সবুজ পাতায় বসন্তের আবাহন । চট্টগ্রাম শহরের সিআরবির শিরিষতলায় মঞ্চে একদল শিল্পীর নাচ চলে ‘আজ ফাগুনের আগুন লাগে পলাশে-শিমুলে’ গানের সঙ্গে। বাতাসে সুরে ঢেউ। ছন্দ আর নুপুরের ঢেউ পলাশ আর শিমুল ফুলে, গাছের শাখায়। ঢেউয়ের দোলা উৎসব অঙ্গনে সমবেতদের মধ্যেও।
সুর, রঙ আর উচ্ছ্বাস ছড়ানো বসন্ত উৎসব
শীতের রুক্ষ ভাব কাটিয়ে প্রকৃতিতে নতুনের সজীবতা। বাঙালির জীবনেও প্রকৃতির সজীবতার ছোঁয়া লেগেছে। তাই-তো ফাগুনের প্রথম দিনটিকে বর্ণিলভাবে বরণের মধ্য দিয়ে বন্দরের এই নগরেও লেগেছে উৎসবের দোলা। সিআরবির শিরীষতলা, শহীদ মিনার, রেলওয়ে জাদুঘর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শিল্পকলা- সবখানেই বসন্তের জয়গান।
প্রতিবছরের মতো এবারও সিআরবির শিরীষতলায় বসন্ত বরণের আয়োজন করেছে প্রমা আবৃত্তি সংগঠন। বন্দরনগরীতে বসন্তবরণের সবচেয়ে বড় আয়োজন এটাই।
বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল সোয়া ৮টায় ঢোল ও ভায়োলিন বাজানোর মধ্য দিয়ে বসন্ত উৎসবের সূচনা হয় শিরীষতলার মঞ্চে। উৎসবের উদ্বোধন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে আবুল মোমেন বলেন, সারাবছর ধরে আমাদের জীবনের যত দু:খ-গ্লানি সব ছাপিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু হয় বসন্তে। মানুষই প্রকৃতির মতো করে বসন্তকে ধারণ করে এগিয়ে যায়। আমাদের প্রকৃতিতে অনেকগুলো ঋতু আছে। একেক ঋতুর একেক বৈশিষ্ট্য। বসন্তে চারদিকে ফুল ফোটে। প্রকৃতিতে যেমন প্রাণের স্পন্দন তৈরি হয়, তেমনি মানুষের জীবনেও।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, প্রকৃতির সময়কে ধারণ করে বিভিন্ন উৎসব পালন বাঙালির ঐতিহ্য, চিরায়ত রীতি। এই কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে আমাদের ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এগুলো আমাদের শেকড়, বাঙালির অস্তিত্বের ভিত।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসানের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পালের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারি হাই কমিশনার অনিন্দ্য ব্যানার্জী, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক নিতাই কুমার ভট্টাচার্য এবং দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহেদ মালেক।
উদ্বোধনী কথামালার পর ওড়িশী নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তীর দলের নাচের মধ্য দিয়ে মূল আয়োজনের দিকে এগিয়ে যায় শিরিষতলার মঞ্চ। ততক্ষণে মঞ্চের সামনে থেকে সিআরবি’র আশপাশের এলাকায়ও ভিড় জমে গেছে। প্রকৃতিপ্রেমী আর উৎসবমুখর বাঙালির কোলাহলের রঙ পুরো এলাকায়।
এর মাঝে মাঝেই শিরিষতলার মঞ্চ থেকে গানা, নাচ, আবৃত্তি পরিবেশন করা হচ্ছে। বসন্ত বাতাসের নতুন ফুলের গন্ধ যেন ছড়িয়ে পড়েছে জড়ো হওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। মাথায় লাল-হলুদ ফুল। হলুদ শাড়ি পরে বাসন্তী সাজে সেজে নারী, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে পুরুষ। কারও গায়ে আবার পলাশ রঙে রাঙা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি অথবা শাড়ি জড়িয়ে শিশুরা শামিল হয়েছেন বসন্ত বরণে।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সিআরবিতে এ নিয়ে আমরা দ্বিতীয় দফায় বসন্ত উৎসবের আয়োজন করলাম। ২০১১ সাল থেকে আমরা ধারাবাহিকভাবে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করে আসছি। আমাদের দুটি লক্ষ্য আছে। একটি হচ্ছে- আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, দেশীয় ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা। আরেকটি হচ্ছে- বাঙালীর আবহমান সংস্কৃতিকে জাগ্রত করে আমরা অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই ‘
এদিকে বোধন আবৃত্তি পরিষদ এবার দুইভাগে নগরীর শহীদ মিনার ও পাহাড়তলী রেলওয়ে জাদুঘরের সামনে শেখ রাসেল ময়দানে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে।
স্বরিৎ ললিতকলা কেন্দ্রের শিল্পীদের সম্মিলিত বংশীবাদনের মধ্য দিয়ে নগরীর শহীদ মিনারে শুরু হয় বসন্তবরণের আয়োজন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো.আব্দুল মান্নান এই আয়োজনের মূলপর্বের উদ্বোধন করেন।
বিভাগীয় কমিশনার বলেন, প্রকৃতিতে ছয়টি ঋতু আছে। প্রতিটি ঋতুই আমাদের জীবন, আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের লেখক-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সবকিছুতেই প্রকৃতি এবং বসন্তের ছোঁয়া আছে। বসন্ত শুধু একটি ঋতুবদলের বিষয় নয়, এটি নতুন করে জীবন শুরু করার প্রেরণা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, সম্মিলিত আবৃত্তি জোটের চট্টগ্রামের সভাপতি অঞ্চল চৌধুরী, বোধন আবৃত্তি পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল হালিম দোভাষ, যুগ্ম আহ্বায়ক সুভাষ বরণ চক্রবর্তী। উদ্বোধন মঞ্চে ছিলেন বোধন আবৃত্তি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পঞ্চানন চৌধুরী এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সুজিৎ রায়, নারায়ণ বিশ্বাস ও পারভেজ চৌধুরী।
শহীদ মিনারের মঞ্চেও গান, নাচ, আবৃত্তি, যন্ত্রসঙ্গীতসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্ত বরণে মেতে উঠেছেন সমবেতরা। সকাল থেকেই শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের আনাগোনা শুরু হয়। এই আয়োজন রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন বোধন আবৃত্তি পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য প্রণব চৌধুরী।
এদিকে নগরীর পাহাড়তলীতে রেলওয়ে জাদুঘর এলাকায় এবার প্রথমবারের মতো বসন্ত বরণের আয়োজন করা হয়েছে। ছায়া-সুনিবিড়, গাছ-গাছালি ঘেরা নগরের ভেতরে যেন একটুকরো ছোট্ট গ্রামে বসন্ত উৎসবে মেতেছে বাঙালি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত এই এলাকা সকাল থেকে বসন্তের জয়গানে মুখর। এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ভিন্ন আমেজ।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের শিল্পীদের একক আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সকালে রেলওয়ে জাদুঘরের সামনে শেখ রাসেল ময়দানে শুরু হয় বসন্ত উৎসব। শুরু থেকেই আশপাশের এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ ভিড় জমাতে থাকে প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই উৎসবে। বেহালা ও বাঁশির সুরে মুগ্ধ দর্শক নাচ-গানেও বিমোহিত হন। একক নাচ-গানের পাশাপাশি পরিবেশিত হচ্ছে দলীয়ভাবেও। একক আবৃত্তির পাশাপাশি পরিবেশিত হচ্ছে বৃন্দ আবৃত্তিও।
বিকেল তিনটা থেকে অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্টজনেরা কথামালায় অংশ নেবেন। সেইসঙ্গে শিল্পীদের পরিবেশনাও থাকবে।
বোধন আবৃত্তি পরিষদের অনুষ্ঠান সম্পাদক অনুপম শীল সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমবারের মতো আমরা রেলওয়ে জাদুঘর এলাকায় উৎসবের আয়োজন করেছি। প্রথমবারেই এত সাড়া পাব, আমরা ভাবিনি। এতে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। আশা করি, আগামীতে আমরা আরও বড় পরিসরে আয়োজন করব।’
বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এস এম আব্দুল আজিজের নেতৃত্বাধীন অংশটির এই আয়োজন রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন অনুপম শীল।
ছবি: শ্যামল নন্দী
সারাবাংলা/আরডি/জেডএফ