Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রিয় মানুষটির হাতে ফুলের সাথে শোভা পেল বই


১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২২:৪৮

।। হাসনাত শাহীন।।

বসন্ত এসে গেছে। প্রকৃতি সেজে উঠেছে নতুন পল্লবে, হাজার-হাজার রকম ফুলের সুরভীত সৌরভ আর দখিণের মাতাল সমীরণের সুরলিত সুরে। এর মাঝে বনে-বাদাড়ে, বাগানে-আগানের গাছে গাছে চলছে পুরোনো পাতা ঝরার নৃত্য। যান্ত্রিক নগরী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর অমর একুশের স্মৃতিধন্য প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চলছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। আমাদের প্রাণের বইমেলা। বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রয়ারি) ছিল এবারের বইমেলার ১৪তম দিন।

বিগত ১৩তম দিনে প্রাণের এ মেলার সঙ্গে যোগ হয়েছে উৎসব প্রিয় বাঙালির ভালোবাসার ঋতু বসন্ত। চিরন্তন নিয়মের ধারাবাহিকতায় আর সময়ের পথ পরিক্রমায় প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে-শীতের রুক্ষতা-শুষ্কতাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের মাঝে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত, বসন্তের প্রথম মাস ‘ফাল্গুন’। ফাল্গুনের এমনই পরিবেশে বৃহস্পতিবার মেলার ১৪তম এবং ফাগুনের দ্বিতীয় দিনে পাতা ঝরা সুরের তালে, নানান ফুলের নানান সৌরভে যেন আগুন ছুঁয়েছে তরুণ-তরুণীর মন। আর সেই আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলো ভালবাসা দিবসের ভালোবাসাময় আবহ। যেন বনে ফাগুন-মনে আগুন আর ভালোবাসাময় মনের দুরন্ত উচ্ছাসে তারুণ্যের প্রাণচ্ছ্বল উপস্থিতিতে মুখোরিত ছিলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তারুণ্যের উচ্ছসিত দীপ্তপদচারণায় আর ভালোবাসাময় আবেগে-আবেশে উদ্বেলিত ছিলো শাহবাগ থেকে টিএসসি, টিএসসি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, দোয়েলচত্বরসহ-এর আশেপাশের সর্বত্র। একদিকে ভালোবাসা দিবস, অন্যদিকে প্রাণের মেলা বইমেলা আর শাহবাগ জুড়ে ভালোবাসা দিবসের নানা আয়োজনে শহরবাসীকে মাতিয়ে রাখে সারাদিন। ভালোবাসায় থাকা দর্শক-শ্রোতা বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝখানের সময়ে বইমেলায় প্রবেশ করলে বইমেলা যেন জমে ওঠে ভালোবাসার পরিপূর্ণ মেলবন্ধনে।

ভালোবাসার মেলবন্ধনের এমন দিনের বইমেলা নিয়ে কথা হয় প্রকাশনা সংস্থা ‘অনিন্দ্য’র প্রকাশক আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে জানান, ‘সারাবিশ্বেই ভালোবাসা জানানোর জন্য এই একটা বিশেষ দিন। সারাবছর একসাথে চলাচল করেও সেভাবে ‘ভালোবাসি’ বলা হয়ে ওঠে না। কিন্তু ভালোবাসা জানানোর এই বিশেষ দিনে তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি অন্যদেরও সেই সুযোগটা হই। বইমেলায় ভালোবাসা দিবসের প্রভাব নিয়ে তিনি বললেন, এই সময়ে মানুষ যে বইমেলায় আসছে, একজন বইয়ের মানুষ হিসেবে এটা প্রচণ্ড ভালোলাগার বিষয়। আমি আশা করি ভালোবাসা প্রকাশের এই দিনের মতো ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে বইমেলার বাঁকি দিনগুলোতেও মানুষ আসবে; বই কিনবে এবং একে অপরকে বই উপহার দিবে।

এর আগে কর্মদিবসের কারণে বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) মেলার প্রবেশদ্বার খোলে বিকেল তিনটায়। তিনটার দিকে মেলায় মেলায় প্রবেশ করে মেলার দুপ্রান্তই দেখা মেলে বসন্তবরণ এবং ভালোবাসা দিবসের স্ববিশেষ সাঁজে সজ্জিত তারুণ্যের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। বিগত পহেলা ফাল্গুনের দিনের মতো এদিনে মেলায় উপচে পড়া ভিড় না থকেলেও যথেষ্ঠ পরিমানের বইপ্রেমী-দর্শকরা আর ভালোবাসা দিবসের পালনে আসা কপোত-কপোতিরা মেলায় প্রবেশের পর থেকেই তারা শুরু করে দেয় পছন্দমত বই বাছাই আর বই কেনা। যেন ভালোবাসার মানুষটির হাতে ফুলের সাথে বই না হলে মানাচ্ছে না! ভবিষ্যতের জীবনসাথীর হাতে প্রিয় লেখকের পছন্দের বইটি তুলে দেওয়ার জন্য গ্রন্থমেলার প্রায় অধিকাংশ স্টলের সামনেই ছিলো ভালোবাসায় উদ্দীপ্ত তারুণ্যের ভিড়। মেলার এসব স্টল-প্যাভিলয়নের সমানে চলেছে বিকিকিনি। এদিন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে উপন্যাস। তবে কবিতার বইও বিক্রি হয়েছে অন্যান্যদিনের তুলনায় অনেক বেশি। বিক্রি হয়েছে প্রবন্ধ, গল্প ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বই।

মেলার এমন দিনে কথা হলো রাজধানীর ধানমন্ডী থেকে মেলায় আসা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের শিক্ষার্থী জান্নাত টুম্পার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, ভালোবাসায় সিক্ত গ্রন্থমেলায় এসে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। কার বই বেশি পছন্দ-এমন প্রশ্নের উত্তরে টুম্পা জানান, হাসান আজিজুল হক, হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের বই তার প্রথম পছন্দ। তাদের বই কেনার জন্যই মেলায় এসেছি। তাদের বেশ কয়েকটা বইও কিনেছি। সামনে আরও কিনবো। এছাড়া বেছে বেছে দেশের এই সময়ের লেখকদেরও বইও কিনি।

আগামীকাল শুক্রবারের মেলা: মহান একুশের চেতনায় উদ্দিপ্ত ও জাগ্রত হওয়ার আমাদের প্রাণের এ বইমেলার আগামীকাল শুক্রবার ফাগুনের তৃতীয় দিন এবং মেলার ১৫তম দিন। এদিন, মেলার প্রবেশ পথ খুলবে সকাল ১১টায় এবং যথারীতি চলবে যথারীতি রাত ৯টা পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। এই শিশুপ্রহরের আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অবস্থিত গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা’র চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। এরপর বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী: শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন-অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন-মোহাম্মদ সাদিক, জাহিদ হায়দার এবং সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন-অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। আর, আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

মেলার ১৪তম দিনের নতুন বই: বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বৃহস্পতিবার মেলায় নতুন বই এসেছে ১৪৭টি। এর মধ্যে গল্পের বই ২৪টি, উপন্যাস ২৯টি, প্রবন্ধ ৬টি, কবিতা ৫০টি, গবেষণা গ্রন্থ ১টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনীগ্রন্থ ৬টি, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই ২টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান বিষয়ক বই ১টি, ভ্রমণ বিষয়ক বই ১টি, ইতিহাস বিষয়ক বই ৩টি, রাজনীতি বিষয়ক বই ২টি, চিকিৎসা-স্বাস্থ্য বিষয়ক বই ১টি, রম্য ও ধাঁধা বিষয়ক বই ১টি, ধর্মীয় গ্রন্থ ১টি, অনুবাদ গ্রন্থ ২টি, অভিধান ১টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য বিষয়ে বই এসেছে ১০টি। এসব বইগুলোর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য বই হলো- আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রবন্ধের বই ‘বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন’, কথাপ্রকাশ এনেছে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’ ও আন্দালিব রাশদী’র গল্পসংকলন ‘ট্যাগোর’, অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোহাম্মদ শাহ্জামানের উপন্যাস ‘জোনাকির আলো’, দেশ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে তরুণ লেখক লুবনা জেরিন লাবনী’র উপন্যাস ‘সোমেশ্বরী’।

বৃহস্পতিবারের মেলামঞ্চের আয়োজন: বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন-ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন-রেজাউর রহমান, আবদুল কাইয়ুম এবং অপরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান।

প্রাবন্ধিক বলেন, একুশ শতকে মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান সাক্ষরতা, বিজ্ঞান মনস্কতা, বৈজ্ঞানিক কা-জ্ঞান ও বিজ্ঞান গবেষণা আলাদা বিষয়। বিজ্ঞানমনস্কতা হলো বিজ্ঞানের দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু ভাবা ও করা। বিজ্ঞানমনস্ক হতে হলে বিজ্ঞানী হতে হবে, এমন নয়, যেকোনো সচেতন মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারেন। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ আমাদের প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক কা-জ্ঞান, পরিশীলিত রুচিবোধ এবং বিচারবুদ্ধি ও মানবিক বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ। তিনি বলেন, আমাদের যত্নশীল হতে হবে শিক্ষামূলক কনটেন্টের প্রতি। আমরা আশা করি এ বিষয়ে গুণগত মান আরও বৃদ্ধি পাবে, বিজ্ঞান গবেষণায় প্রণোদনা যুযোপযুগী হবে, বৈশ্বিক মানের গবেষণা আমরা যাতে দেশেই করতে পারি সেই উদ্যোগ গৃহীত হবে, বিদেশে প্রশিক্ষিত বিজ্ঞান-গবেষক দেশেই থিতু হবেন, তারা রুচিশীল টেক্সট ও কনটেন্ট উপহার দেবেন-এইরকম বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’য় কোনো পার্থক্য থাকবে না।

সভাপতির বক্তব্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে। আমরা আশা করি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আরও অগ্রগতি সাধন করবে।

আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি আমিনুর রহমান সুলতান এবং সাকিরা পারভীন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ এবং মাহিদুল ইসলাম । সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী খুরশিদ আলম, সুজিত মোস্তফা, তানভীর সজীব আলম, মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ, আঞ্জুমান আরা শিমুল, মো. রেজওয়ান আহমেদ। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল (তবলা), সুমন রেজা খান (কী-বোর্ড), মো. নোমান রেজা রিয়াদ (অক্টোপ্যাড) এবং শাহরাজ চৌধুরী তপন (গীটার)।

বৃহস্পতিবারের ‘লেখক বলছি…’ মঞ্চ: বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘লেখক বলছি…’ মঞ্চে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন দেশের পাঁচজন লেখক। এর মধে আকিমুন রহমান আলোচনা করেন এবারের মেলায় গ্রন্থকুটির থেকে প্রকাশিত ‘অচিন আলোকুমার ও নগন্য মানবী’ বইটি নিয়ে, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক কথা বলেন প্রথমা থেকে প্রকাশিত ‘এই পথে আলো জ্বেলে’ বইটি নিয়ে, প্রাবন্ধিক রাহাত মিনহাজ কথা বলেন শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: কি পেয়েছিল ভুট্টোর পাকিস্তান’ বইটি নিয়ে, গল্পকার মাহবুব ময়ুখ রিশাদ আলোচনা করেন প্রকাশনা সংস্থা অনিন্দ্য থেকে প্রকাশিত ‘তর্কশয্যায় মৃত্যু’ বইটি নিয়ে এবং কবি চাণক্য বাড়ৈ কথা বলেন ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস ‘কাচের মেয়ে’ বইটি নিয়ে।

সারাবাংলা/এমআই


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর