‘যখন আগুন-আগুন বলে চিল্লাইতেছিলাম, সবাই আমারে পাগল বলছিল’
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:০৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘আমি যখন আগুন-আগুন বলে চিল্লাইতেছিলাম, সবাই আমারে পাগল বলছিল। সবাই বলছিল, মহিলাটা পাগল হয়ে গেছে, আগুন-আগুন বলতেছে। তার কিছুসময় পরেই দেখি, সব লোকজন বের হইয়া যাইতেছে।’ বৃহস্পতিবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আগুন লাগার ঘটনা শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) এভাবেই বর্ণনা করছিলেন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজন ২৫ বছর বয়সী হুসনে আরা।
শুক্রবার সকালে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কথা হয় হোসনে আরার সঙ্গে। তিনি জানতে এসেছেন, তার মেয়েকে ভর্তি করা হবে কি না। হলেও কবে নাগাদ।
হুসনে আরা বলেন, ‘হাসপাতালের সার্জারির ৮ নাম্বার ওয়ার্ডে ছিলাম আমরা। বিকাল ৫ টা ৪০ মিনিটে আগুন লাগে, পেছনের দিকে ধুমা (ধোঁয়া) দেখতে পাইছি। ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে যখন বলতেছিলাম, আগুন লাগছে-আগুন লাগছে, সবাই আমারে পাগল বলতেছিল। তার কিছুসময় পরেই দেখি, সব লোকজন বের হইয়া যাইতেছে। সবাই মাঠে বইসা ছিল, সবাই আতঙ্কিত ছিল। হঠাৎ করে এত বড় হাসপাতালে এত বড় আগুন। ’
‘হাসপাতালে সবাই বাঁচতে আসে’ মন্তব্য করে হুসনে আরার পাশা থেকে আরেক রোগীর স্বজন বলেন, ‘সেখানে আইসাই যদি মরণের দশা হয়, তাইলে কেমনে হইবো?’ তিনি বলেন, ‘কালকে মনে হইছিল, এইটাই বোধহয় কেয়ামতের মাঠ, আমরা পুলসিরাত পার হইতাছি। ভাবি নাই যে, এইখান থেকে বাইর হইতে পারমু।’
আরও পড়ুন: শিশুসহ ৪টি ওয়ার্ড অনুপযোগী, সোহরাওয়ার্দীতে বাকি কার্যক্রম চলছে
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই চিকিৎসকসহ সবাই প্রস্তুত। জরুরি বিভাগের সামনে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা বড় টেবিল নিয়ে বসে আছেন—আগের রাতে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা রোগীদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সেখানে প্রস্তুত ট্রলি, হুইল চেয়ার। রোগীদের নাম-ঠিকানা তথ্য নিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিজ নিজ ওয়ার্ডে।
বহির্বিভাগের ইনচার্জ ডা. মোস্তফা কামাল রউফ পুরো বিষয়টি তদারকি করছিলেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শতভাগ প্রস্তুত। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকেই হাসপাতালের সবাই মিলে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরুর জন্য কাজ শুরু করেছি। এরইমধ্যে অনেক রোগী আসতে শুরু করেছেন। বাকিদের প্রতিও আমরা বলব, এখানে চিকিৎসাসেবা স্বাভাবিক করতে আমরা কাজ করছি।’
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগুন লাগার ফলে হাসপাতালের চারটি বিভাগ সম্পূর্ণ পুড়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ওয়ার্ড চারটি হলো—শিশু ওয়ার্ড, নারীদের একটি সার্জারি ওয়ার্ড, নারীদের একটি মেডিসিন ওয়ার্ড ও একটি কেবিন ওয়ার্ড। বাকি ওয়ার্ডগুলোয় আগুন ছড়িয়ে পড়লেও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
এদিকে, নারীদের সার্জারি ও মেডিসিন ওয়ার্ড দুটি করে থাকায় একটি ওয়ার্ডের রোগীদের সংশ্লিষ্ট অন্য ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে শিশুদের ওয়ার্ড একটি থাকার কারণে তাদের হাসপাতালে ফিরিয়ে এনে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেও জানায় কর্তৃপক্ষ। ফলে একশ’ ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা শিশুদের রিসিভ করছে না হাসপাতাল।
হুসনে আরা বলেন, ‘আট বছরের মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলাম গত শনিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) থেকে। ছোট বেলায় আগুনে পুড়ে গিয়ে মেয়েটার পেটের অনেকখানি ক্ষত অবস্থা। এখানেই বার্ন ইউনিটে ভর্তি ছিল। সার্জারির সব প্রস্তুতি শেষ।’ চিকিৎসক আর পরিবারের সবাই প্রস্তুত। কেবল সার্জারির তারিখটা ঘোষণা হবার অপেক্ষায় ছিল, হয়তো আজ-কালকের মধ্যে তাও হয়ে যেতো পরেও হুসনে আরা মন্তব্য করেন। তার আক্ষেপ—যে আগুনের কারণেই ছোট্ট মেয়েটির পেট পুড়লো, আবার সেই আগুনের কারণেই মেয়েটার সুস্থ হওয়াও হলো না এবার।
আরও পড়ুন: হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি
ক্ষুদ্র ব্যবসায় স্বামী আর আট বছরের এই মেয়েকে নিয়ে হুসনে আরা থাকেন হাসপাতালের পেছনেই বিএনপি বস্তিতে।
হাসপাতালের দিকে তাকাতে তাকাতে হোসনে আরা বলেন, ‘অনেক তো ক্ষতি হইছেই। সব তো আর প্রকাশ হইতো না, কিন্তু চিকিৎসা খুব ভালো। হাসপাতাল খুবই ভালো। ডাক্তার, নার্স আয়া সবার কাছ থেকেই ভালো ব্যবহার পাইছি।’
মেয়েকে নিয়ে কবে আবার হাসপাতালে আসবেন—জানতে চাইলে হুসনে আরা বলেন, ‘মেয়েটা কাল অনেক ভয় পেয়েছে। সে আর আসতে চাইতাছে না হাসপাতালে। তবু যদি বোঝায়ে নিয়ে আসতে পারি!’ কিন্তু হাসপাতাল থেকে শিশুদের আরও পরে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ