Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দখলদারদের জেদের বলি ৮ প্রাণ


১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:১৬

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম নগরীর চাক্তাইয়ে কর্ণফুলী নদী এবং রাজাখালী খালের মোহনায় গড়ে ওঠা চর দখল করে বানানো হয়েছিল বিশাল বস্তি। কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য যেসব জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে চাক্তাইয়ের বেড়া মার্কেট সংলগ্ন বস্তিটিও আছে। কর্ণফুলীতে উচ্ছেদ শুরুর পর জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা গিয়ে একাধিকবার বস্তির বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

বিজ্ঞাপন

প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে প্রায় দু’শরও বেশি বস্তিঘরের বাসিন্দারা চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু এই সরকারি খাসজমির দখলদাররা এতে বাধ সাধেন। কখনও হুমকি-ধমকি, আবার কখনও হাইকোর্টে গিয়ে উচ্ছেদ বন্ধে স্থগিতাদেশ আনার কথা বলে তাদের থাকতে বাধ্য করেন। এরপরও অনেকে বস্তি ছেড়ে চলে যান। যারা থেকে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আগুন। জীবনের শেষ সম্বল, সহায়-সম্পদও বিসর্জন দিতে হয়েছে আগুনে।

সব হারানো মানুষগুলো তাই এখন ক্ষোভে ফুঁসছেন সেই দখলদারদের বিরুদ্ধে, যারা নিম্ন আয়ের মানুষগুলোকে তাদের দখল করা ভূমিতে ঘর বানিয়ে ভাড়া দেন।

রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচটিরও বেশি কলোনিতে বিভক্ত বেড়া মার্কেট সংলগ্ন এই বস্তির প্রায় দুই শতাধিক ঘর ও দোকান পুড়ে যায়। আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা গেছে  তিন পরিবারের আটজন।

 

ঘটনাস্থলে গিয়ে সহায়-সম্বল হারানো মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে জায়গায় আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, প্রকৃত বেড়া মার্কেট সংলগ্ন কলোনির অবস্থান এর থেকে আরও প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী মেরিন রোডের উত্তরে রাজাখালী খালের চর দখল করে ২০০০ সালের দিকে গড়ে তোলা হয় নতুন বস্তি।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে এই বস্তির নিয়ন্ত্রণ আছে নগরীর ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি আকতার ওরফে কসাই আকতারের নিয়ন্ত্রণে। তার সঙ্গে আছে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী করিম নামে আরও একজন। তারা স্থানীয় সাত্তার, হেলাল, ফরিদ, বেলালসহ কয়েকজনকে এই বস্তির ভাড়াটিয়াদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়েছে। এরাই বস্তি থেকে প্রতিমাসে ভাড়া তোলে।

আরও পড়ুন: চোরের ভয়ে দরজায় তালা, প্রাণ নিয়ে গেল আগুন

দীর্ঘদিন ধরে বেড়া মার্কেট এলাকায় বসবাসকারী সাইফুদ্দিন নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০০০ সালে কসাই আকতার ও করিমসহ ১০৮ জন মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তারা এই বিশাল খাসজমি দখল করে কাঠা হিসেবে ভাগ করে নিয়েছে। সেই জমিতে তখনই বস্তি তুলে তারা ভাড়া দেয়। তবে মূল নিয়ন্ত্রণ আছে আকতার ও করিমের কাছে। কারণ তারা রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী।’

পুড়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দারা জানান, বস্তিতে ঘরপ্রতি ভাড়া ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হত। বিদ্যুতের সংযোগ ছিল। তবে গ্যাসের সংযোগ ছিল না। তারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করত।

বস্তির বিভিন্ন কলোনির মধ্যে বেলাল কলোনির বাসিন্দা রেহনুমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘নদীর পাড়ে উচ্ছেদ শুরু হয়েছে, এটা আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। সপ্তাহ দু’য়েক আগে সরকারি লোকজন এসে আমাদের চলে যেতে বলে। আমরা চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেলাল এসে হুমকি দেয় যে, আমাদের যেতে হলে দুইমাসের ভাড়া দিয়ে যেতে হবে। তখন আমরা আর যেতে পারিনি।’

‘বাড়িওয়ালার’ জেদের কারণে এখন তাদের সহায়-সম্বল সব হারাতে হয়েছে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রেহনুমা।

আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া রহিমা আক্তারের ভাই মো.আকবর সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে আমাদের চলে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ঘরের মালিক এসে বলেন- তিনি হাইকোর্টে গিয়ে সব ঠিক করে আসবেন। উচ্ছেদ হবে না। তখন আমরা রয়ে যায়। অথচ অনেকেই চলে গেছে।’

বস্তিতে বসবাসকারী দুই শতাধিক পরিবারের মধ্যে আগুন লাগার আগ পর্যন্ত ৬০-৭০টি আছে বলে জানিয়েছেন সেখানে বসবাসরতরা। প্রতিটি কলোনিতে ১০-১২টি করে পরিবার তখনও বসবাস করছিল বলে তারা জানান।

মেরিন ড্রাইভ রোডের একপাশে আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তি এবং আরেক পাশে আরও একটি বস্তি আছে, যেটা কসাই আকতারের বস্তি নামে পরিচিত। সেটিও কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চরের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে।

সেই বস্তির সামনে বসে সবজি বিক্রি করেন স্থানীয় বাসিন্দা খাদিজা আক্তার। খাদিজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে প্রশাসনের লোকজন এসে আমাদেরও চলে যেতে বলেছে। কেউ কেউ চলে গেছে। কেউ এখনও আছে।’

আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কসাই আকতার একসময় বিএনপি করত। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত কয়েকবছর ধরে সে নিজেকে আওয়ামী লীগ পরিচয় দিচ্ছে। এখন শুনতে পাচ্ছি সে যুবলীগের পদে আছে।’

এদিকে বস্তি খালি করতে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে, এমন আলোচনা শোনা গেছে বস্তির বাইরের এলাকায় বসবাসরতদের আলোচনায়। তবে বাসিন্দাদের কেউ এমন বলতে নারাজ। তারা শুধু দুষছেন যাদের কাছ থেকে তারা ঘর ভাড়া নিয়েছেন তাদের।

তবে দুই সপ্তাহ আগে বস্তিতে গিয়ে সরে যাবার নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানেন না বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রনব চৌধুরী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার কাছে লিখিত কোন নির্দেশনা আসেনি। কেউ বস্তিতে এসে তাদের সরে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন- এমন খবরও আমার জানা নেই।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পুড়ে যাওয়া বস্তিগুলো উচ্ছেদ কার্যক্রমের তৃতীয় পর্যায়ে অর্ন্তভুক্ত ছিল। বস্তিগুলো খালি করার জন্য বাসিন্দাদের পাশাপাশি দখলদারদের কাছেও তথ্য পাঠানো হয়েছিল।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো.ইলিয়াস হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বস্তির মালিকা কারা, সেটা আমরা খতিয়ে দেখব। এই বস্তি বৈধ কি অবৈধ সেটাও আমরা তদন্ত করে দেখব।’

এদিকে রোববার দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ও চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এসময় স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী নূরুল হকও ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/জেডএফ

চট্টগ্রামে আগুন বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর