এবারও প্রকাশের তালিকায় শীর্ষে কবিতার বই, বিক্রিতে কম
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১১:৩৮
।। হাসনাত শাহীন ।।
সাহিত্যের আদিমতম শাখা-কবিতা। এর একটি শব্দে প্রকাশ করতে পারে মনের অনেক না বলা কথা। তাতে মন খারাপের যেমন গল্প থাকে, তেমনি থাকে ভালো থাকার মন্ত্রও। শিল্প-সাহিত্য জগতে যুগের পর যুগ ধরে কবিতাতেই বলা হয়েছে মনের না বলা অব্যক্ত কথা। কবি-সাহিত্যিকদের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বোদ্ধারা বলেন থাকেন, আমাদের এ অঞ্চলের মানুষের মূল ভাষাটাই হচ্ছে—কাব্যের বা কবিতার। ক্ষোভ, প্রতিবাদ, আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা সবকিছুর প্রকাশেই আমরা কবিতার কাছে যাই—কবিতা লিখি, কবিতা পড়ি। যুগে যুগে কবিতা ভাব প্রকাশের উর্বর নক্ষত্র হিসেবে প্রসারিত হয়েছে। খুব কম মানুষই আছে; যারা তার তারুণ্যে কবিতা লেখেননি বা কবিতা লেখার চেষ্টা করেননি কিংবা ভালবাসাসহ যাপিত জীবনের বার্তা তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। আর এ কারণেই হইতো প্রতিবারের বইমেলায় সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয় কবিতার বই।
কবি-সাহিত্যিক এবং শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বোদ্ধাদের এমন কথকথার সত্যতা মিলেছে বাঙালির প্রাণের মেলা এবারের এই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও। যার আয়োজক অমর একুশের চেতনাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির জনসংযোগ ও সমন্বয় উপবিভাগও জানাচ্ছে সেই কথায়। তারা বলছেন—‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র যত দিন অতিবাহিত হচ্ছে, আসছে শত শত নতুন বই। প্রতিবারের মতো এবারও পাঠকদের আগ্রহে যা-ই থাকুক না কেন প্রতিদিনই সবচেয়ে বেশি আসছে কাব্য-কবিতার বই।
রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) এবারের মেলার ১৭তম দিন পর্যন্ত কবিতার বই এসেছে ৭৯১টি। যা, যেকেনো ধরনের বইয়ের তুলনায় কবিতার বইয়ের সংখ্যা এবারও অনেক বেশি। এভাবে কবিতার প্রকাশ হতে থাকলে মেলার শেষ দিকে গিয়ে এবারও কবিতার বই প্রকাশের এ সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে, এবিষয়ে দেশের সৃজনশীল প্রকশনা সংস্থার প্রকাশকরা বলছেন, এই সংখ্যা আরও বেশিও হতে পারে। বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে যেসব বই একাডেমির জনসংযোগ বিভাগে জমা দিয়েছে সেখান থেকে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তুবিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। তারা বলছেন—এই দোষ আমাদেরই। কেন না, আমরা যথা সময়ে সব বই একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা দিতে পারি না—দেওয়া হয়ে ওঠে না। এসময় বিক্রয় কেমন হচ্ছে জানাতে চাইলে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা জানান, কবিতার বই সবসময় কম বিক্রি হয়। এবারও তেমনই আছে। তবে, অন্যান্যবারের মতো এবারও বিগত পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে এই কবিতার বইয়ের বিক্রিও হয়েছে বেশ ভালো। এইসব দিনগুলোতে প্রিয়জন, বন্ধুদের জন্য উপহার হিসেবে কবিতাকেই বেছে নিয়েছেন তরুণ-তরুণীরা।
এবষিয়ে অনন্যা প্রকশনীর স্বত্বাধিকারী মনিরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, কবিতা সব সময়ই কম বিক্রি হয়। কবিতার পাঠক কমে গেছে। কবিতা পড়ার মানুষ আলাদা, সেই মানুষ এখন খুবই কম। তাছাড়া এখন ভালো মানের কবিতাও তেমন একটা হচ্ছে না। এসময় তিনি জানালেন, তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবার মোট ২৫টি মতো কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের কিছু অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাব্যগ্রন্থ ‘নাইলন গোলাপ টেবিলে’, মহাদেব সাহার ‘কোথা পাই দিব্যজ্ঞান’, নূহ-ইল-আলম-লেলিনের ‘এক মুঠো রোদেলা বিকেল’, হাসান হাফিজের ‘রমনীয় কুহকের টান’, দিলারা হাফিজের ‘নারী সহিংসতা’।
প্রকাশনা সংস্থা আবিষ্কারের সত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেন জনালেন তার প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু কবিতার বই। যার অধিকাংশ কবি তরুণ। কবিতার বই কেমন বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে দেলোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, চলমান বা বহমান রাজনীতিতে কবিরা সাহস হারিয়ে ফেলছে। যে কথাটা বলার দরকার, সেই কথাটা বলছেন না—বলতে পারছেন না। ফলে, পঞ্চাস-ষাট-সত্তুর দশক কিংবা নব্বইয়ের দশকের কবিদের মতো বিপ্লবীচেতনার সঙ্গে এখনকার কবিদের কবিতা দেশ-জাতি ও মানুষের কল্যাণের জন্য তেমন ভূমিকাও রাখছেন। কবিতাই যে প্রাণের সঞ্চার থাকে সেই প্রাণের দেখাও মিলছে না। যে কারণে, কবিতার বই খুবই কম বিক্রি হচ্ছে। যা বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশই লেখকরাই তার বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্যদের দিয়ে কেনাচ্ছেন।
এদিকে, প্রকাশনা সংস্থা বেহুলা বাংলার সত্বাধিকারী চন্দন চৌধুরী জানালেন, তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবার মোট বই প্রকাশিত হচ্ছে ১৫০টার মতো। এর মধ্যে ১০০টা কবিতার বই। ইতিমধ্যে ৮০টির মতো কবিতার বই মেলায় চলে এসেছে। বাকিগুলো দুই-একদিনের মধ্যেই চলে আসবে।
মেলার প্রায় সবপ্রকাশনা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টরা যেখানে বলছেন কবিতার বই খুবই কম বিক্রি হয়। এ জন্যে তারা কবিতার বই কম প্রকাশ করেন। সেখানে আপনি এত কবিতার বই প্রকাশ করেছেন! বিক্রি কেমন হচ্ছে—এমন কথার জবাবে চন্দন চৌধুরী জানালেন, আমার এখানে কবিতার বই-ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, মেলার সময়সীমা যত ফুরিয়ে আসছে এসব নতুন বইয়ের গন্ধের টানে প্রতিদিনই ছুটে আসছে বইপ্রেমীদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরাও। প্রতিদিন প্রকাশিত হচ্ছে শতশত নতুন বই। এবারের গ্রন্থমেলার আজ রোববার ১৭তম দিনে নতুন বই এসেছে ৭১টি। এর মধ্যে গল্পগ্রন্থ ৭টি, উপন্যাস ৭টি, প্রবন্ধ ৮টি, কবিতা ৩১টি, ছড়া ২টি, শিশুসাহিত্য ১টি, জীবনীগ্রন্থ ৩টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ৩টি, ভ্রমণ বিষয়ক বই ২টি, স্বাস্থ্য বিষয়ক বই ১টি, রম্য ও ধাঁধার বই ১টি, ধর্ম বিষয়ক বই ১টি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ১টি এবং অন্যান্য বিষয়ে উপরে বই এসেছে ৩টি। প্রতিদিনের মতো এদিনও সবচেয়ে বেশি এসেছে কবিতার বই বা কাব্যগ্রন্থ; যার সংখ্যা ৩১টি।
এবারের মেলায় সবচেয়ে বেশি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে প্রকাশনা সংস্থা ‘বেহুলা বাংলা’ থেকে। তাদের হিসাব মতে এবারই প্রকাশিত ১৫০ বইয়ের মধ্যে ১০০টা কবিতার বই। এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই সময়ের কবি মাহফুজা অনন্যার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কামার্ত নগরের কামিজ’। এছাড়াও বেহুলা বাংলার প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হলো- কবি অরবিন্দ চক্রবর্তীর ‘রাত্রির রঙ বিবাহ’, আহমেদ শিপলুর ‘কোনো প্রচ্ছদ নেই’, তানভীর জাহান চৌধুরীর ‘ভালোবাসা সয় না আমার দুঃখ হয় না পর’ এবং মারুফা জাহানের ‘নৃ-চিহ্ন গাঁথা’।
এছাড়াও এবারের বইমেলা বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ কবিদের বেশকিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বই হলো- ‘পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স’ প্রকাশ করেছে-কবি ও বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ ‘ঈহা’, কবি পিয়াস মজিদের কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেম পিয়ানো’। অনন্যা প্রকাশ এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নাইলন গোলাপ টেবিলে’ ও মহাদেব সাহার ‘কোথায় পাই দিব্যজ্ঞান’সহ বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। ‘অন্যপ্রকাশ’ থেকে এসেছে কবি শিহাব শাহরিয়ারের কাব্যগ্রন্থ ‘পড়ে থাকে অহংকার’, তরুণকবি ও সাংবাদিক হক ফারুক আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গতার পাখিরা’, মারুফুল ইসলামের ‘নতুন করে পাব বলে’, দিলরুবা শাহাদৎ-এর ‘বসন্ত স্বপ্নের আলোছায়ায়’ এবং ইসমত সুলতানার ‘আমি চিত্রাঙ্গদা’। নতুন প্রকাশনা সংস্থা চন্দ্রবিন্দু প্রকাশ করেছে কবি ও উপন্যাসিক মাজহার সরকারের ‘চিৎকার রণিত হৃৎপিণ্ডে’, কবির হোসেনের ‘ভাড়ায় চালিত পা’সহ আরও কয়েকটি বই। বাতিঘর থেকে প্রকাশিত হয়েছে একঝাক তরুণের কাব্যগ্রন্থ; যা নাকি বিক্রিও ভালো হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের ‘কলহ বিদ্যুৎ’, রিমঝিম আহমেদের ‘ময়ূরফুলের সন্ধ্যা’ এবং আহমেদ মুনিরের ‘জেল রোডের প্রেমগীতি’। আগামী প্রকাশনী এনেছে-শাহিদ আনোয়ারের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, জাহিদ হাসান ‘বিদ্রোস্পী’ ও কামরুল নাহার সিদ্দীকার কবিতার বই ‘জল জ্যোৎস্না যমুনা’। অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে-রুদ্র গোস্বামীর ‘কথাটি ছিল’ ও ‘ভালো বাসব বলেই’ এবং মো. মেহেবুব হকের কবিতার বই ‘ভালোবাসার নীল পদ্ম’। নাগরী প্রকাশনী থেকে এসেছে আবু হাসান শাহরিয়ারার ‘বিমূর্ত প্রণয়কলা’। পুথিনিলয় এনেছে-কামরুজ্জামান টিপুর বই ‘শূন্য’, পারিজাত প্রকাশনী এনেছে-সুমাইয়া করিমের ‘নিঃশব্দে এসেছিলো সে’, নন্দিতা প্রকাশ এনেছে-জাহাঙ্গীর হাফিজের ‘বুকের ভিতর লেলিহান’ ও শামীম পারভেজের ‘রঙে রঙে মোড়ানো হৃদয়’ এবং আনোয়ার মজিদের ‘জলে ধুয়ে যায় জলে’, মুক্তচিন্তা প্রকাশনী এনেছে-মোহাম্মদ আলী খানের ‘একুশের বর্ণমালা’ এবং ‘মওলা ব্রাদার্স’ থেকে এসেছে সোহরাব হাসানের ‘বাতিল রাজদ-’ এবং সৌরভ সিকদারের ‘মায়াভরা পৃথিবীর ছায়াপথে’-সহ আর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ।
সারাবাংলা/এমআই