Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এই শিশুদের কাছে হার মেনেছে ক্যান্সার


১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:৫৩

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: আবু বকরের বয়স তখন দুই বছর। কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ায় ২০১৬ সালে তাকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা আশঙ্কা করেন হার্নিয়া হতে পারে। সে অনুযায়ী ১০ থেকে ১৫ দিন চিকিৎসা চলে। এই সময়ের মধ্যে নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, পেট ফুলে ওঠতে শুরু করে বকরের। টঙ্গী সদর হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।

বিজ্ঞাপন

নানা পরীক্ষার পর ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আবু বকরের হার্টে বড় টিউমার রয়েছে। কিছু দিন ওষুধ সেবন করলে টিউমারের আকার ছোট হয়ে আসবে, তারপর অস্ত্রোপচার।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে সংগ্রামের গল্প বলছিলেন শিউলী। আবু বকর এখন বুঝতে পারে, তাকে নিয়েই কথা হচ্ছে।

আবু বকর ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কেবল আবু বকরই না। মাইশা, অরণ্য, লাবনী, মালিহাসহ আরও ক্যান্সারাক্রান্ত শিশুদের মিলন মেলা বসেছিল ঢামেক হাসপাতালে। বিশ্ব শিশু ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে এই আয়োজন করে ঢাকা শিশু হেমাটোলজি এবং অনকোলজি বিভাগ। সেখানেই এসব শিশুর মায়েদের সঙ্গে কথা হয়।

চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পরলে এবং সঠিক চিকিৎসা পেলে ক্যান্সার থেকে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।

শিউলী বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর তিনবার থেরাপি দেওয়া হয়েছে বকরকে। তারপর পেটের ফোলা কমে আসে। এর তিনমাস পর অপারেশন হয়। কিন্তু ওর শারীরিক অবস্থা আরও বেশি খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তাররাও আশা ছেড়ে দিয়েছিল, আমাকে বলছিল বাড়ি চলে যেতে।

বিজ্ঞাপন

টানা ২১ দিন পর্যন্ত প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত গেছে। ডাক্তারদেরকে বললাম, আমি বাড়ি যাব না, ছেলেটা মরে গেলে যাব- এর আগে না… বলে কোলে বসে থাকা আবু বকরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন শিউলী। বকরও চোখ তুলে মায়ের মুখের দিকে তাকায়, গলা জড়িয়ে ধরে। যেন বোঝাতে চাইছে- আমি যাইনি মা, তোমার কোলেই আছি।

নিজেকে সামলে নিয়ে শিউলী বলেন, আমাকে পাঠানো হলো হাসপাতালের ২০২ নম্বর রুমে। যেটাকে বলা হয়, পেলিয়েটিভ রুম। যারা এ ধরনের কঠিন রোগে আক্রান্ত, তাদের জীবনের শেষকটা দিন যেন একটু ব্যথাহীন হয়, কষ্ট কম হয়, সেজন্য সেখানে পাঠানো হয়। সেখানে যাওয়ার কয়েকদিন পর ছেলেকে দেখে কিছুটা সুস্থ মনে হয়। সেখানে একদিন যান খসরু স্যার (শিশু হেমাটোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ খসরু)। স্যার দেখেই চিনতে পারেন। বলেন, ‘এটা আবু বকর না? ও এখনও বেঁচে আছে!’

এরপর স্যার ওর ওজন মাপেন। দেখা যায়, ওজন বাড়ছে। তখনই স্যার বলেন, এখন ওকে থেরাপি দেওয়া যাবে। সেই শুরু হলো ছেলেকে বাঁচতে সবার যুদ্ধ। স্যারের কথা সারাজীবন মনে মনে থাকবে। ডাক্তারদের চেষ্টা না থাকলে ছেলেকে ফেরৎ পেতাম না- বলেন শিউলী।

হাসপাতালের ২১০ নম্বর রুমে শুরু হলো থেরাপি দেওয়া। সাত মাসে সাতটা থেরাপি চললো। তারপর চলে গেলাম বাড়ি। সেটা আড়াই বছর আগের কথা। এখন ছেলেটা সুস্থ আছে, ছয় আর তিনমাস পর পর কেবল কিছু পরীক্ষা করতে হয় এখানে আসে।

কথা প্রসঙ্গে শিউলী জানান, তার স্বামী পোশাক কারখানায় কাজ করেন। চিকিৎসার সময়ে খরচ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা, এখনো দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ মাথার ওপর। সব টাকা স্বজনের কাছ থেকে নেওয়া।

বলেন, ওর বাবা খুব অল্প বেতন পান। বেতন নিয়ে ঘরে ঢোকার পর সেখান থেকে প্রথমেই পাঁচ হাজার টাকা সরিয়ে রাখি, ধারের টাকা ফেরৎ দেওয়ার জন্য। এভাবেই এখনো টাকা দিয়ে যাচ্ছি। স্বজনদের কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। এখনো তারা বলে- সময় নাও, চাপ নিও না।

কৃতজ্ঞতা জানালেন ঢামেক হাসপাতালে শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাহনুর ইসলামের প্রতি। বলেন, সাহনুর ম্যাডাম অনেক হেল্প করছেন। অপারেশনের সময় ব্ল্যাড লাগছিল, আরও কত কী! সব কিছু সাহনুর ম্যাডাম করছেন। থেরাপির টাকাও দিয়েছেন।

এই যুদ্ধের আরও গল্প বলেন শিউলি আক্তার। ওর বাবা থাকতে পারতেন না। একদিন কাজে যেতে না পারলে ৫০০ টাকা কেটে রাখে। আমার শ্বশুর আর ভাই ছিল।

সাত মাস থেরাপি চলেছে, একাও থাকতে হয়েছে। টেস্ট করানো, ওষুধ কেনা, খাবারের ব্যবস্থা করা- একা পারতাম না। তারপরও করতে হতো। বাচ্চাকে একা রেখে চলে যেতাম সেই ধানমন্ডি। আমি কিছু চিনি না, লেখাপড়া জানি না। তবে সেসব কিছু মনে রাখতে চাই না, কেবল চাই আমার সন্তানটা সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকুক। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তিনি আমার বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

জানালেন, আবু বকর এখন স্কুলে যায়। শিউলীর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন- ছেলে সুস্থভাবে বড় হবে, লেখাপড়া শিখবে, মানুষের মতো মানুষ হবে।

সারাবাংলা/জেএ/এটি

ক্যান্সার শিশুদের ক্যান্সার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর