Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধীরে ধীরে বন্ধ হচ্ছে সব জুয়ার সব সাইট


২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৭:৫৩

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: ইন্টারনেটকে নিরাপদ রাখতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ভারত থেকে পরিচালিত জুয়া খেলার জনপ্রিয় ওয়েবসাইট তীর কাউন্টার ডটকমের ডেস্কটপ ভার্সন। বন্ধ হয়ে গেছে বেট৩৬৫ ডটকমের মোবাইল ভার্সন, আন্তর্জাতিকভাবে বাজির জনপ্রিয় অধিকাংশ ওয়েবসাইটও বন্ধ হওয়ার পথে। এখনও সচল থাকা বেটিং সাইট বা অনলাইনে জুয়া খেলার সব সাইটই ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়া হবে। গত কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জুয়া বন্ধ হয়েছিল। জুয়া যে ফর্মেই হোক, বাংলাদেশে তা নিষিদ্ধ। আর বেটিং সাইট সম্পর্কে আমাদের কাছে প্রচুর অভিযোগও আসছিল।’

মন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর থেকেই আমরা এসব সাইট বন্ধের উদ্যোগ নিতে শুরু করি। ধীরে ধীরে এমন সব সাইট বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু অনলাইনে কোনো একটি সাইট বন্ধ করলাম, আবার অন্য একটি সাইট চালু হতে পারে। তাই আমাদের এ কার্যক্রম চলতে থাকবে। বেটিং সম্পর্কিত সব সাইট বন্ধ করে দেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের খারাপ কাজকে আমরা সমর্থন করি না। ভার্চুয়াল জগতকে নিরাপদ রাখতে এরই মধ্যে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। শুধু বেটিং সাইট নয়, বিভিন্ন পর্ন সাইটও বন্ধ করছি। ধীরে ধীরে ক্ষতিকর অন্য সাইটগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার এক প্রশ্নের উত্তরে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘সব তো একেবারে বন্ধ করা যাবে না। আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের যতটুকু সাধ্য আছে, চেষ্টা করছি। এখনও কার্যকর থাকা ক্ষতিকর সাইটগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হবে।’

বেটিং সাইট সম্পর্কে জানতে চাইলে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবি’র সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছু ওয়েবসাইটে ক্রেটিড কার্ডের মাধ্যমে বাজি ধরা বা জুয়া খেলা যায়। আবার কিছু সাইটে ক্রেডিট কার্ড ছাড়াই জুয়া খেলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। গত কয়েক বছরে এসব সাইটে ভিজিটরও বেড়েছিল। তবে এটি খুব একটা মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। তবে সরকার যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়েই ব্যবস্থা নিয়েছে, তাই অঙ্কুরেই বিষয়টিকে প্রতিহত করা গেছে বলে আমরা মনে করি।’ সরকারের এসব উদ্যোগকে সাধুবাদও জানান তিনি।

বেটিং সাইট কী
অনলাইনের যেসব ওয়েবসাইটে খেলা বা অন্য কিছুর নামে বাজি ধরা (জুয়া খেলা) হয়, সেগুলোই বেটিং সাইট নামে পরিচিত। সাইটগুলো মূলত খেলা বিষয়ক। এসব সাইটে খেলা সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তেই আপডেট পাওয়া যায়। থাকে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের ব্যবস্থাও। আর ম্যাচ চলাকালীন খেলায় কোন দল জিতবে, কত রানে দল জিতবে, কোন প্লেয়ার কত রান করবে, কে টস জিতবে, ফুটবলে কে গোল দেবে কিংবা কোন দল জিতবে— এমন বিষয়ে নানা ধরনের বেটিং পুল নির্ধারণ হয়। আর ওইসব সাইট ব্রাউজ করা খেলাপ্রিয় জুয়ারিরা মেতে ওঠে বাজি ধরায়। এছাড়াও বেটিং সাইটগুলোতে ক্যাসিনো বা পোকারের মতো জুয়ার আসরেও বাজি ধরে থাকেন জুয়ারিরা।

অন্য একটি তথ্য থেকে জানা গেছে, অনলাইনে জুয়ার এমন কিছু সাইট রয়েছে, যেগুলোতে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অনেকটা লটারির মতো ফল প্রকাশ করা হয়। দেশের কয়েকটি অঞ্চলে তীর কাউন্টার ডটকম নামক এমন একটি জুয়ার আসর জনপ্রিয়।

অনলাইন বেটিংয়ে জড়িত ছিলেন— এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, বাংলাদেশ থেকে বেট৩৬৫ নামক আন্তর্জাতিক সাইটটিতে সবচেয়ে বেশি বেটিং করা হয়। সাইটটিতে আইডি খুলতে এনআইডি, পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগে। তবে সবসময় এনআইডি দিয়ে আইডি খোলা যায় না। সেসব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য ব্যবহার করতে হয়।
তিনি আরও জানান, বেটিংয়ে অর্থের ক্ষেত্রে দু’টি মুদ্রা ব্যবহৃত হয়— ইউএসডি (মার্কিন ডলার) ও ইউরো। অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হওয়ার পর এবং নিজের অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা করার পর বাজি ধরা যায়। যেকোনো খেলার লাইভ স্ট্রিমিং চলাকালে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে ম্যাচ, বল, ওভার, ম্যানভিত্তিক বিট করা যায়। কোন দল জিতবে, কে কত রান করবে, কোন ওভারে কত রান হবে— বাজিগুলো সাধারণ এমন হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যাসিনো বা পোকারের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সময়েও বাজি ধরা যায়।

সারাবাংলার প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও জানান, চার-পাঁচ বছর আগে থেকেই দেশে বেটিং চলে আসছে। তবে সাম্প্রতিকালে যে হারে বেড়েছে, অতীতে জুয়ার প্রসার এতটা বেশি ছিল না। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও জানান, জুয়া খেলায় তো কেউ আর লাভবান হয় না, জুয়া মানেই লস। এক সময় খেলেছি। এখন আর আগ্রহ নেই। ছেড়ে দিয়েছি।

জানা গেছে, দেশে পাঁচ থেকে ছয় বছর আগে বেটিং সাইটের প্রসার ঘটতে শুরু করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তরুণ সমাজের কাছে এ সাইটগুলো বহুল প্রচলিত হয়ে উঠতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি এখনও তেমনভাবে মহামারীর আকার ধারণ করেনি। তার আগেই মূল উদঘাটন করা হয়েছে। তবে ভিপিএনের যুগে সাইট বন্ধ করে কতটা সুফল পাওয়া যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে আইটি বিশেষজ্ঞদের।
আন্তর্জাতিকভাবে বেটিং সাইটের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বেট ৩৬৫ ডটকম। আইপিএল বা বিপিএল চলাকালীন সাইটিতে বাংলাদেশি ক্রিকেট জুয়ারিদের হাট বসে। জনপ্রিয় কোনো আসর শুরু হলেই সাইটটিতে অন্য সময়ের চেয়ে ব্রাউজার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আর বাংলাদেশে তখন এ বেটিং সাইটের অবস্থান অ্যালেক্সা র্যাংকিংয়ে ৫০-এর নিচে নেমে আসে।

আরও জানা গেছে, বেটিং সাইটে লেনদেন হয় পেপ্যাল, মাস্টার কার্ড, ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, গলফ, ঘোড়াদৌড়সহ আন্তর্জাতিক সব ধরনের খেলাই বেটিং সাইটের অন্তর্ভুক্ত। গ্রাহকদের সহায়তা করতে সাইটটিতে থাকে ২৪ ঘণ্টার হেল্প ডেস্ক। করা যায় লাইভ চ্যাট। আবার এ সাইটির অ্যাকাউন্টও বিক্রি হয়। কারণ ১৮ বছরের নিচের কোনো শিক্ষার্থী সাইটটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ সাইটের অ্যাকাউন্ট ২ থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব জুয়ার সাইটে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নেটেলার ডটকম ও স্ক্রিল ডটকম নামের দু’টি সাইট। বিশ্বের ১৭টি বিভিন্ন ভাষায় পরিচালিত হয় এ সাইট। আর আর্থিক লেনদেন হয় ২৮ টি মুদ্রায়। এসব সাইটের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রেও গড়ে উঠেছে একটি অবৈধ শ্রেণি।

সম্প্রতি সরকার এসব সাইট বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি সবার নজরে আনেন এবং জানান, ধীরে ধীরে এসব সাইট বন্ধ হবে। ১৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রী এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে ২ হাজার ২৩৫টি জুয়ার সাইটের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার তথ্য জানান।

এছাড়া সম্প্রতি বন্ধ করা হয়েছে ১৭৬টি জুয়া সম্পর্কিত ওয়েবসাইট। এর মধ্যে কয়েকটি সাইট হলো— ৩২ রেড ডটকম, ৮৮৮ ক্যাসিনো ডটকম, ৮৮৮ পোকার ডটকম, ৮৮৮ স্পোর্ট ডটকম, এডিজারা বেট ডটকম, বেট অ্যাট হোম ডটকম, বেট ৩৬৫ ডটকম, মোবাইল বেট ৩৬৫ ডটকম, ক্যাসিনো বেট ৩৬৫ ডটকম, বেটক্রিজ ডটকম, বেটিকা ডটকম।

এর আগে, ২০১৬ সালের শেষদিকে ১২টি বেটিং সাইট বন্ধ করেছিল বিটিআরসি। ওই সাইটগুলো হলো— বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম ও পেডি পাওয়ার ডটকম।

জানা গেছে, জনপ্রিয় বেট ৩৬৫ ডটকম বন্ধ করা হলেও মোবাইল থেকে সাইটটি দেখা যাচ্ছিল। তবে মঙ্গলবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে মোবাইল থেকেও এই সাইটটি দেখা যায়নি। শীর্ষ অবস্থানে থাকা আরও বেশ কিছু সাইটও বন্ধ পাওয়া গেছে। ভারতের শিলং থেকে পরিচালিত তীর কাউন্টারের কিছু সাইটও বন্ধ পাওয়া গেছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর