শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে কলাগাছের স্মৃতির মিনার
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৮:১৩
।। মো. আশিকুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।
রাজবাড়ী: বিদ্যালয়ে স্থায়ী কোন শহিদ মিনার নেই। কিন্তু তাতে কী? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ভাষা শহিদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কোন কমতি নেই ওদের। আর তাই তো কলাগাছ দিয়ে শহিদ মিনার বানিয়ে তাতে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছে ওরা।
বলা হচ্ছে রাজবাড়ী জেলা সদরের বসন্তপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর গ্রামের ‘জাতীয় তরুণ সংঘ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষার্থীদের কথা। বিদ্যালয়ে ইট-সিমেন্টের তৈরি শহিদ মিনার না থাকায় প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি কলাগাছ দিয়ে অস্থায়ী মিনার বানিয়ে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কলাগাছ দিয়ে অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে শিক্ষকরাও রয়েছেন।
এসময় বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকাশ মোল্লা সারাবাংলাকে বলে, আমাদের বিদ্যালয়ে শহিদদ মিনার নেই। প্রতিবছর আমরা কলাগাছ ও কাদা মাটি দিয়ে শহিদ মিনার তৈরি করে ভাষা শহিদদের স্মরণ করি।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে কোন শহিদ মিনার নেই। প্রতিবছর নিজ উদ্যোগে শহীদ মিনার তৈরি করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করি। আর শহিদ মিনার তো মূলত একটা প্রতীক মাত্র। তাই ইটের হোক আর কলা গাছেরই হোক, শ্রদ্ধা নিবেদনটাই মূখ্য বিষয়। নিজ হাতে শহিদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা অনেক তৃপ্ত হয় বলে আমরা লক্ষ্য করেছি।
‘জাতীয় তরুণ সংঘ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ মতো রাজবাড়ী জেলার পাঁচটি উপজেলার ৭শ’ ৪৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬শ’ টিতেই নেই স্থায়ী শহীদ মিনার। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটিতে এভাবে কলাগাছ দিয়ে অস্থায়ী শহিদ মিনার বানিয়ে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়। কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না বানিয়ে শুধু আলোচনা সভা বা মিলাদ মাহফিল করে দিবসটি পালন করা হয়। আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে তা-ও করা হয় না। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমী বলেন, জেলায় মোট ৪৮২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৪২টিতে স্থায়ী শহিদ মিনার রয়েছে। আসলে বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে কোন অর্থ বরাদ্দ নেই। যে কারণে ইচ্ছা থাকা শর্তেও বিদ্যালয়গুলোতে শহিদ মিনার নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে ৪২টি বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার রয়েছে ওই বিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা দিয়ে এবং স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করে শহিদ মিনার নির্মাণ করেছে।
জেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুন্নাহার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, জেলায় মোট ১৪৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৭৪টি মাদরাসা ও ৪৩টি কলেজ রয়েছে। এসবের মধ্যে ৯৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে, একটি মাদরাসায় ও ১৩টি কলেজে স্থায়ী শহীদ মিনার রয়েছে। যেসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কোন শহিদ মিনার নেই সেসকল প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে শহিদ মিনার তৈরির ব্যবস্থা করা হবে।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, জাতির যেসকল শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি তাদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে কোন অর্থ বরাদ্দ নেই। আমরা ইতিপূর্বে বিভিন্ন মিটিংয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষদের তাদের ফান্ড থেকে শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। এরপরেও তারা যেহেতু শহিদ মিনার নির্মাণ করেননি, আমি মনেকরি দায়িত্ব অবহেলার পাশাপাশি তাদের চেতনাবোধেরও অভাব রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্যদের সদইচ্ছা থাকলেও প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতোদিনে শহিদ মিনার নির্মাণ হয়ে যেত। এটি সম্পূর্ণই সদইচ্ছার ব্যাপার।
প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষদের নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানান জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
সারাবাংলা/এমএইচ