‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার, ভয় কী বন্ধু’
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২০:৫১
।। মিনহাজুল আবেদীন।।
ফাল্গুনের এক মধুর ক্ষণে স্লোগান উঠছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘চলো, চলো অ্যাসেমব্লি চলো’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’। ১৯৪৭ সালে সৃ্ষ্ট অদ্ভুত এক দেশ পাকিস্তানের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিলো সে স্লোগান। দেশের বৃহত্তর মানুষের ভাষাকে স্বীকার না করার এক উদ্ভট পাঁয়তারাকে চোখ রাঙ্গানি দেওয়া শুরু হয় এই মিছিল থেকেই। একটি দেশের বয়স যখন মাত্র এক বছর, সেই দেশের মানুষ নিজের দেশের ডাকটিকেট, মানি অর্ডারের কাগজটি পড়ে বুঝতে পারে না, তার মনে ক্ষোভ জন্ম নেয়। সেই ক্ষোভ দানা বাঁধে। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদে ভাষার প্রশ্নে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব করেছিলেন উর্দু, ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পাকিস্তানের ৬ কোটি নব্বই লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি চল্লিশ লাখের মুখের ভাষা সেই দাবি তুলতেই পারে। কিন্তু এই প্রস্তাবের বিপরীতে পাকিস্তানের শাসকযন্ত্রের চালকেরা ধীরেন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসে। কোনো কোনো নেতা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবেও আখ্যা দিয়ে দিলেন। সেইদিন থেকেই বাঙালিদের ভাষার জন্য সংগ্রামের পথ শুরু। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটি ২৫ ফেব্রুয়ারি খারিজ করে দিলে ২৬ তারিখেই এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘটের ডাক আসে। বাঙালিদের মানুষ হয়েও খাজা নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধাচরণের প্রতিবাদও আসে ২৬ তারিখের ধর্মঘটের দিন থেকেই। ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্বে ছিল ঢাকার সচেতন ছাত্র সমাজ। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে যারা যুক্ত ছিলেন এবং যারা বুঝতে পেরেছিলেন ভাষার অধিকার থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করে রাখতে পারলেই এরা চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে। পশ্চিমে ঝুঁকে পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্র প্রশাসন, সরকারি চাকরি আর সুযোগ সুবিধা থেকে বাঙালিদের বঞ্চিত করে যাবে। তাই ছাত্রনেতারাই ছিলেন এই আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে। তাদের কাছ থেকেই সিদ্ধান্ত আসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে সারা প্রদেশজুড়ে হরতালসহ বিক্ষোভ কর্মসূচির। ১১ তারিখ তরুণ বারুদে বিস্ফোরণ হয়, পুলিশের নিপীড়নের ফলে দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া। ১১ মার্চের কর্মসূচি ১৫ মার্চ পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রীর শান্তি প্রস্তাবে শান্ত হয় ছাত্রসমাজ। আগুনে নতুন করে ঘি ঢালতে পশ্চিম থেকে উড়ে আসেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ। ২১ মার্চ রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আর ২৪ তারিখ কার্জন হলে উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এই ঘোষণা দিয়ে যান। মৌচাকে ঢিল দিয়ে জিন্নাহ পশ্চিমে পাড়ি জমালেন।
বাংলা ভাষাকে পদদলিত করার কৌশল চলতে থাকে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিবাদ চলতে থাকে। তমদ্দুন মজলিস চালাতে থাকে ভাষার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদের মতো ব্যক্তিরা একদম শুরু থেকেই বাংলা ভাষার পক্ষে কথাবার্তা আর প্রচার-প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৫১ সালে কুমিল্লায় এক শিক্ষক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।’ সৈয়দ মুজতবা আলী ভবিষ্যতবাণী করে বলেছিলেন, বাঙ্গালিকে তার ভাষার দাবি থেকে বঞ্চিত করা হলে সেই ক্ষোভ থেকে জন্ম নেওয়া বিদ্রোহ থেকেই বাংলার জনগণ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে যাবে। মানুষের মনে একটু একটু করে জমা হতে থাকে শুকনো বারুদ, কোনো এক ফাগুনে একদল তরুণ রক্তের স্ফুলিঙ্গ লাগাবে বলে সারা বাংলা তখন অপেক্ষায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস বিল্ডিং-এর আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রস্তুতি। পায়ে বাঁধা শিকল ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার ডাক আসলো বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনের কাছ থেকে। আবদুস সামাদ আজাদের প্রস্তাবমতে দশজনের ছোট ছোট গ্রুপে মিছিল করে বেরিয়ে যাবে ছাত্রছাত্রীরা। তাদের লক্ষ্য হবে পরিষদ ভবন। জমা বারুদে স্ফুলিঙ্গ লেগে গেল ঠিক সেই মুহুর্তে।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চারদিকে পুলিশ। ঠিক মাঝখানে গণপরিষদ তাদের লক্ষ্য। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়া ছাত্রদের শ্লোগানে প্রকম্পিত চারপাশ। পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের মহড়া চলতে থাকে। বৃহস্পতিবার, আইনসভার বাজেট অধিবেশন শুরু হবে বিকাল তিনটায়। ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা বন্ধ করে, ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। ছোটখাটো মিছিল হচ্ছে ১৪৪ ধারাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই। এর মাঝেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ। কোথাও কাঁদানে গ্যাস, কোথাও লাঠিচার্জ, কোথাও গ্রেফতার করা হচ্ছে নির্বিচারে।
এরমধ্যে একটি মিছিল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে আইনসভার দিকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানীতে জানা যায়, শাসক শ্রেণির প্রথম বুলেট আঘাত করে মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন আহমদকে। এরপর লুটিয়ে পড়ে আবদুল জব্বার। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবুল বরকতের উরুতে আঘাত করে ঘাতকের বুলেট। সচিবালয়ের পিয়ন আবদুস সালামের গোড়ালিতে গুলি লাগে। তাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল মারা যান তিনি। অজ্ঞাত পরিচয় অনেক লাশ উঠে পুলিশের গাড়িতে। হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে। যাদের অবদানে আমরা গর্বের সঙ্গে বিশ্বের যেকোনো জায়গায় উচ্চারণ করি প্রতিটি বাংলা শব্দ।
এই ঘটনার প্রতিবাদ শুরু হয় সব মহলে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব করেন মুখ্যমন্ত্রীকে অবিলম্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনা সম্পর্কে বিবৃতি দিতে হবে। তাকে সমর্থন করেন মনোরঞ্জন ধর ও মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যেতে রাজি না হওয়ায় মওলানা তর্কবাগীশসহ বেশ কয়েকজন সভাকক্ষ ত্যাগ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, আগের রাতে মর্গ থেকে রফিক আর জব্বারের লাশ নিয়ে গেছে পুলিশ, লাশ নিয়ে মিছিলে নামতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই লাশ উধাও করে দিয়েছে তারা। কিন্তু এই বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাবে কে? বিপুল মানুষ শহিদদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেয়। অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সিনেমাহল সবকিছু স্থবির আর থমথমে, মানুষের শ্লোগানে মুখর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর আশপাশের এলাকা। ‘আজাদ’ এর ভাষ্যমতে, ‘শুক্রবার শহরের অবস্থার আরও অবনতি, সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব। পুলিশ আর সেনাদের গুলিতে নিহত চার আহত শতাধিক।’
২৩ তারিখ ঢাকার মানুষের মুখে স্লোগান, ‘শহীদস্মৃতি অমর হোক’, ‘খুনি নুরুল আমিনের বিচার চাই’, ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রদের মাথায় ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় আসে। নকশা আঁকেন মেডিকেল ছাত্র বদরুল আলম। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেও কারফিউ। রাতের অন্ধকারেই মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য রাখা ইট, বালু আর পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দার নামে এক ব্যক্তির গুদাম থেকে নিয়ে আসা সিমেন্টে গড়ে উঠে আমাদের ভাষা আর স্মৃতির প্রথম মিনার। ২৪ তারিখ সকালে শফিউরের পিতা শহীদ মিনার দেখে অনানুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে দিয়ে যান। সারা বাংলার মানুষের ঢল নামে সেই শহীদ মিনারে। একবারের জন্য শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতে শুরু করে সবাই। ২৬ তারিখ পুলিশ গুড়িয়ে দিয়ে যায় সেই মিনার, ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গণেও একটি শহীদ স্মৃতির মিনার ছিল, সেটিও বাদ যায়নি। কিন্তু যে মিনার বাঙালির হৃদয়ে ছিল তা ভাঙবে কেমন করে। কংক্রিটের মিনার তো মুহূর্তের ব্যাপার! এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) বসে আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছিলেন,
‘স্মৃতির মিনার
ভেঙেছে তোমার? ভয় কী বন্ধু
আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ
কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙ্গতে।’
এরপর অনেক অত্যাচার আর নির্যাতনে স্টিমরোলার গেছে বাঙালি ছাত্র সমাজের ওপর দিয়ে। গ্রেফতার আর আদালতে হেনস্থা হতে হয়েছেন অনেকেই। অনেক টালবাহানা আর ছলচাতুরীর পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের নতুন সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং বাংলা।’
সেই স্বীকৃতির পর ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। নকশা করেছিলেন ভাস্কর হামিদুজ্জামান আর নভেরা আহমেদ। মূল নকশা থেকে অনেক কিছু বাদ দিয়েই নির্মাণ শেষ হয় ১৯৬৩ সালের শুরুতে। ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম উদ্বোধন করেন সেই শহীদ মিনার। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে হাজারো মানুষ জমায়েত হোন এই প্রাঙ্গণে।
এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে স্মরণ করেন শহিদদের, স্মরণ করেন জাতির সূর্য সন্তানদের। আমাদের মুখের প্রতিটি বাংলা শব্দে, লিখিত অক্ষরে বেঁচে আছে সেই শহিদেরা। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকবেন এই অগ্রপথিকেরা।
সারাবাংলা/এমআই