‘শিশুটিকে কোলে রেখেই পুড়ে গেলেন মা’
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:৪৩
।।উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: ‘‘রাজধানীর চকবাজারের রাজমহল হোটেলের ওপর তলায় থাকতো ফাতেমাদের পরিবার। আগুন লাগার খবর পেয়ে চার বছরের ফিটফুটে শিশু ফাতেমাকে বুকে জড়িয়ে বাঁচার জন্য নিচে নেমে আসেন মা আনিকা তাবাসসুম নেহা। এসেই ‘বাঁচাও’, ‘বাচাও’ বলে চিৎকার শুরু করেন। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই তাদের। আবার কেউ বাঁচাতেও এগিয়ে আসছে না। দূর থেকে সবাই দেখলেন শিশুটিকে কোলে রেখেই আগুনে পুড়লেন মা।’’ এভাবে বুধবার রাতে চকবাজারের ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুন লাগার ঘটনার বর্ণনা দেন ফায়ার সার্ভিসকর্মী সবুজ খান।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবকিছুর বিনিময়ে যদি শিশুটি আর মাকে বাঁচাতে পারতাম, তাহলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। ’ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
এরআগে রাত আড়াইটার দিকে সারাবাংলাকে তিনি বলেছিলেন, ‘সারি সারি লাশ, লাশের ওপর লাশ।’
আরও পড়ুন: ৩ বন্ধু বেঁচে ফিরেছে, একজন লাশ, এখনও নিখোঁজ রোহান
ঘটনার সময় চকবাজার চুড়িহাট্টা শাহি জামে মসজিদের ডান দিকে কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দিয়ে রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন পটুয়াখালীর নুর আলম। ডান হাতের রগ কাটা, মাথায় ১০টি সেলাই আর পিঠের দিকে সোয়েটার ছেঁড়া। ঢাকা মেডিকেল থেকে চিকিৎসা নিয়ে রিকশা নিতে এসেছেন তিনি। কিন্তু ঘটনাস্থলে এসে হতভম্ব হয়ে পড়েন। চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংস্তূপ।
আলম বলেন, ‘রাত ১০টার পর প্রচণ্ড জ্যাম ছিল ওই গলিতে। রিকশা, ভান, প্রাইভেটকার, ছোট পিকআপ, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও পায়ে হাঁটা লোকজন ছিল ভরপুর। কিছুতেই সরছিল না জ্যামটা। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে আগুনের গোলা এসে সবাইকে শুইয়ে দিলো। আমি ছিটকে আরও পেছনে ড্রেনে পড়ে গেলাম। সামান্য জ্ঞান ছিল, তাই মেডিকেল যেতে পেরেছি।’
আগুনের ভয়াবহতার কারণ বর্ণনা করেন ভস্মীভূত হওয়া ওষুধের দোকান হায়দার মেডিকোর লিটন। তার ভাই মঞ্জু ও তিন বন্ধু নাসির, আনোয়ার ও হীরাকে সন্ধ্যায় দোকানে রেখে পাশেই বাসায় যান। আগুন লাগার খবর পেয়ে লিটন ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা ছাড়া কিছু দেখতে পাননি। তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় প্রত্যেক বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার আছে। দিনের বেলা গ্যাসের গন্ধে থাকা যায় না। ওইসব সিলিন্ডার থেকে পারফিউমের বোতলে ভরানো হয়। এগুলো সব দুই নম্বর পারফিউম। ওয়াহেদ ম্যানশনে কেমিক্যালের গোডাউন রয়েছে। ড্রামে ড্রামে সেখানে কেমিক্যাল মজুদ ছিল। ওপরে বার্মিজ জুতার গোডাউন ছিল। লাখ লাখ বোতল পারফিউম ভরে রাখা হয়েছিল।’
আরও পড়ুন: লাশ বাড়ছে ৬২-৬৩-৬৫-৬৭-৭০
চুড়িহাট্টা মসজিদের বাম গলিতে থাকেন নাবিল। তিনি মসজিদের সামনে থেকে তরকারি কিনে কেবল বাসায় প্রবেশ করেছেন। এরপরই বিকট শব্দ শুনতে পান। তিনি বলেন, ‘একের পর এক এমন শব্দ হচ্ছিল, যেন কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে। জ্যাম থাকায় কেউ বাঁচতে পারেনি। ’
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘রাস্তা না থাকায় ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক গাড়িগুলো প্রবেশ করতে পারেনি। রাসায়নিক গোডাউনের কারণে আগুনের ভয়াবহতা ছিল বেশি। ফলে পানিও কাজ করেনি। এক ভবনের সঙ্গে আরেক ভবনের ইঞ্চি পরিমাণও ফাঁক রেখে ভবন করা হয়নি। এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে। জেলখানার পুকুর থেকে পানি টানা হয়েছে। পরে কিছু বাসার রিজার্ভ থেকে পানি নেওয়া হয়েছে। ’ আগুন যতই লাগুক কেমিকেল ও পারফিউমের বোতল না থাকলে এত ভয়াবহতা হতো না বলেও জানান ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা।
সারাবাংলা/ইউজে/এমএনএইচ