Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাতির এলাকায় মানুষের পাড়া: ঝুঁকি, শঙ্কা


১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ২০:২২

মাকসুদা আজীজ ও ওমর ফারুখ হিরু

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আবাস গড়েছে কক্সবাজার, টেকনাফ ও এর আশেপাশের এলাকাতে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আসা প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ নিজেরাই বন ও পাহাড় কেটে বসিয়েছে আবাসস্থল। তবে এই বন মানুষের নয়। হাতির, শত বছর ধরে বাস করা বন্য প্রাণীদের।

মানুষের ঘরে হঠাৎ আগন্তুক বাস শুরু করলে মানুষ তাতে বাধা দেয়, তো পশু পাখিরাই বা এই নিয়মের বাইরে কীভাবে যাবে? আর সক্ষমরাই যে এ পৃথিবীতে টিকে থাকে- এ সত্য বন্যরা বরং মানুষের চেয়ে ভালো জানে।

টেকনাফ ও উখিয়াতে ৪ হাজার ৩০০ একর  পাহাড়ি এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের আবাস। শুধু নতুনরাই নয়, আগে থাকা রোহিঙ্গারাও এখানে ইচ্ছেমতো উজাড় করেছে বন। শিকার করেছে বন্য প্রাণী। তাদের ব্যবহার করা পানি ও শৌচকাজে বন্ধ হয়েছে বনের বহু নালা, দূষিত হয়েছে প্রাকৃতিক পানি ব্যবস্থাপনা।

অন্য সব প্রাণী মানুষের এই আগ্রাসন মেনে নিলেও মানেনি হাতিরা। এই বন তাদের। শত সহস্র বছর ধরে এই বনে তারা বাস করছে, তৈরি করেছে নিজেদের পথ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই একই পথে চলে তারা। পথ বদল তাদের স্বভাব বিরুদ্ধ! আর এই বিবেচনায় বন্য প্রাণীদের রক্ষা করার আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এবং বাংলাদেশ বন বিভাগ মিলে ‘সাবধান! হাতি চলাচলের পথ’ লেখা বোর্ড বসিয়ে দিয়েছে। তবে এই সতর্কতা উপেক্ষা করে বালুখালিতে তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গাদের আবাস। সে পথের উপরই আছে রোহিঙ্গাদের জন্য ৫০ শয্যার মেডিকেল ক্যাম্প!

গত আড়াই মাসে হাতির হামলায় একই পরিবারের ৪ জন সহ ১২ রোহিঙ্গা মারা গেছে। আহত ২৫ জনেরও বেশি।

বিজ্ঞাপন

আজ (শুক্রবার) ভোরেও কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধুরছড়া এলাকায় হাতির হামলায় মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী (৪৫) নামে এক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। এ সময় হুড়োহুড়িতে তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমসহ আহত হয় আরও ৩ জন। বিধ্বস্ত হয় ছয়টি ঘর।

ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বলেন, আজ ভোররাতে দুটি বন্য হাতি লোকালয় থেকে কিছুটা দূরের ওই রোহিঙ্গা বসতিতে হামলা চালায়। এ সময় ঘটনাস্থলেই ইয়াকুব আলী মারা যান।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও জীববিজ্ঞানী ড. কামরুল হাসান দীর্ঘদিন কাজ করছেন এ এলাকার বন্য প্রাণীদের নিয়ে। তিনি বলেন, কক্সবাজার ও টেকনাফের যে অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গারা এসে বসতি গড়েছে, সেটি মূলত হাতিদের চলাচলের পথ। তাদের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই পথে চলা। এ পথকে বলে হাতি চলাচলের করিডোর। যে কোনো প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়েই তারা এগিয়ে যায়। বিশাল কোনো প্রাকৃতিক পরিবর্তন না ঘটলে এ পথ পরিবর্তন করে না।

এখন শীতকাল, এ সময়ই হাতিদের খাবারের অভাব দেখা দেয়। তা ছাড়া শুকনো মৌসুমে ছড়াগুলো শুকিয়ে পানির সংকটও তুঙ্গে। ফলে খাবার ও পানির সন্ধানে হাতির পাল বিশাল এলাকা জুড়ে ঘুরে বেড়ায়।

বর্ষাকালে যখন রোহিঙ্গারা এখানে বসতি গড়ে তখন হয়তো হাতিরা ঠিক এ জায়গাটিতে ছিল না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তারা ফিরে আসবে না। এটা তাদেরই এলাকা, তারা ফিরে আসবেই।  এখানে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আছে, পানি আছে, লোনাপানির ঝরনা আছে। বেঁচে থাকার জন্য এগুলো হাতিদের দরকার! ব্যাখ্যা কামরুলের।

বিজ্ঞাপন

হাতির কারণে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে-এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করে এ প্রাণিবিজ্ঞানী বলেন, যখন হাতিদের পথে মানুষ এভাবে বসতি গড়ে তখন দুই রকমের ঘটনাই ঘটে। হাতির হামলায় যেমন মানুষ আহত-নিহত হয়, তেমনি মানুষও সংঘবদ্ধ হয়ে হাতিদের উপর হামলা চালায়। এতে অনেক সময় হাতিও মারা যায়। তবে এখানে মানুষের বুঝতে হবে, হাতি গায়ে পড়ে মানুষকে আক্রমণ করে না। মানুষই তাদের চলাচল ব্যাহত করে।

হাতিদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প বসানোর সমালোচনা করে কামরুল বলেন, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় হাতিদের একাধিক করিডোর রেয়েছে। এই করিডোরগুলো জিপিআরএস-এর আওতায়। যখন প্রশাসন এসব এলাকায় রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প স্থাপন করে তখনই আমরা বিষয়টি তাদের অবহিত করেছি, তারপরেও সেটাকে আমলে না নেওয়ায় হাতি এবং মানুষের মধ্যেকার এই সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে।

এদিকে, এসব এলাকায় আতংকে কাটছে রোহিঙ্গাদের জীবন। এমনটাই জানান ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা। হাতি কখন আসবে তারও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, দিনে আসলে তাও পালিয়ে বাঁচা যায়। রাতে কীভাবে প্রাণ বাঁচাবে তা জানা নেই, নিজ দেশ থেকেই তাড়া খাওয়া এ মানুষগুলোর! জীবন তাদের তপ্ত কড়াইতে, না জ্বলন্ত উনুনে রেখেছে তাই এখনও বুঝতে পারছেন না তারা। তবে যেখানেই হোক, দুর্ভোগ আর মৃত্যু ঝুঁকির থেকে মুক্তি নেই তাদের।

বিশ্বজিৎ সেন বাঞ্চু কক্সবাজারের স্থানীয় একজন পরিবেশকর্মী। তিনি জানান, প্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল রক্ষায় রোহিঙ্গাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার উচিত। রোহিঙ্গারা প্রাণী চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে যার ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজার বন বিভাগ (দক্ষিণ) এর কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী কবির জানান, কক্সবাজার এবং বান্দরবনে হাতির বসবাসের ১২টি করিডোর রয়েছে। এসব করিডোরের কাছাকাছি মানুষের বিচরণ বাড়ায় বিরূপ আচরণ করছে হাতিরা।

তবে এগুলো শুধু মুখের কথা নয়। সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি) কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রকাশ করে। এতেও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর দুটি সংরক্ষিত এলাকা, হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্ক ও টেকনাফ অভয়ারণ্যের খুব কাছে রয়েছে। তাই শিবিরগুলো দেশের জীব বৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা আছে, বন উজাড় করে বসতি গড়ে ওঠা বন্ধ না হলে সেখানে কিছু প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসভূমি চিরতরে হারিয়ে যাবে। বনগুলোকে আর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। এ ছাড়া ভূমির যে ক্ষতি হচ্ছে তাও অল্প সময়ে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের জীব বৈচিত্র্যের জন্যও একটি বড় হুমকি।

সারাবাংলা/এমএ/এসআই

 

আইইউএনসি ইউএনডিপি রোহিঙ্গা হাতি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর