Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৮ বছরেও হয়নি রাসায়নিক পল্লি: কার দায়, মন্ত্রণালয় না ব্যবসায়ীদের?


২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২১:৫২

।। হাসান আজাদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) রাসায়ানিক পল্লি করার উদ্যোগ নেওয়ার ৮ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তবে গেলো বছর প্রকল্পের অনুমোদন পেলেও চলতি বছরে আরও ৫ মাস পরে শুরু হবে জমি অধিগ্রহণের কাজ। তাতেও শুরু করা যাবে না। কারণ প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ বলতে এখনো কিছুই দেওয়া হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে এই প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে।

বিজ্ঞাপন

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তবে অনুমোদনের দুই মাস পর বাস্তবায়নকারী সংস্থা গত ৩ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে।

প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের এই দীর্ঘসূত্রিতার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাই শুধু নয়, বিষয়টিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ২০১০ সালে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকার রাসায়নিকের কারখানা ও গোডাউন সরাতে নেওয়া প্রকল্পের অনুমোদন পেতে আট বছর সময় লাগার মানেই হলো এর কোনো গুরুত্ব ছিল না।

তারা বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। আরও আগে রাসায়নিকের ব্যাপারে সরকার কঠোর হলে ও সঠিক সময়ে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হলে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এর দায়ভার কোনোভাবেই শিল্প মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না, বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।

যদিও মন্ত্রণালয় ও বিসিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণেই প্রকল্প গ্রহণে দেরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: চকবাজারে আগুন: গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকটে বেড়েছে দুর্ভোগ

শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আবদুল হালিম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেরানীগঞ্জ রাসায়সিক পল্লি নির্মাণে এরইমধ্যে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অর্থ বছরের মাঝামাঝিতে হওয়ার কারণে কোনো বরাদ্দ না থাকায় এখনই কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। তবে, আমরা কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’

আগামী অর্থ বছরে বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করা হবে জানিয়ে প্রকল্প গ্রহণে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে আবদুল হালিম বলেন, ‘কেন দেরি হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। অল্পদিন হলো আমি এই মন্ত্রণালয়ে এসেছি। খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জেনেছি, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের অনীহার কারণেই প্রকল্প গ্রহণে দেরি হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মোশতাক হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিসিক রাসায়নিক পল্লি জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। জমি অধিগ্রহণের কাজটি করবে জেলা প্রশাসকের দফতর। জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হলে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কেরানীগঞ্জের কেমিক্যাল শিল্প জোন তৈরির কাজ শুরু করবো।’

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নিমতলীর মতো ঠিক একই কারণেই চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিমতলীর ঘটনাকে আমি হত্যাকাণ্ড বলব। নিমতলীর ঘটনার পর যে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন হলে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না। ‘ তিনি বলেন, ‘এই দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট দফতরও এড়াতে পারবে না।’

আরও পড়ুন:  ‘নিমতলীর ঘটনার ঘাটতি পূরণে এবার আটঘাট বেঁধে নেমেছে সরকার’

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুরান ঢাকা বসবাসের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আবাসিক এলাকার মধ্যে কলকারখানা, দোকানপাট, কেমিক্যাল ব্যবসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে দাহ্যপদার্থ থাকে। যার ফলে জায়গাটি অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আদালত থেকে হুকুম দেওয়া হয়েছে পুরান ঢাকা থেকে এসব প্রতিষ্ঠান সরানোর জন্য। এখন আইনের মাধ্যমে কঠোর হয়ে তাদের সরাতে হবে। এজন্য সিটি করপোরেশন, রাজনীতিবিদ, রাজউক, পরিবেশ অধিদফতর, শিল্প অধিদফতরকে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু মুখের কথায় হবে না। কারণ কারোই দায় এড়ানো সম্ভব নয়।’

শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিকের সংশ্লিমষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন নিহতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। পরে ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল ১০ সদস্যের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটিতে স্বরাষ্ট্র, শিল্প ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিরা ছিলেন। ওই কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, পুরান ঢাকায় থাকা ৪ হাজার কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া হবে। ২০১১ সালের ২০ জুলাই গঠিত কমিটি প্রতিবেদন আকারে একটি সুপারিশ জমা দেয়।

ওই সুপারিশে বলা হয়, কেরানীগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীর পাশে ২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে, সেখানে ৭ তলাবিশিষ্ট ১৭টি ভবন নির্মাণ করে তাদের সরিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৫ সালে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠানকে (বিসিক) দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিসিক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) প্রস্তুত করে। ওই ডিপিপিতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। ডিপিপিতে বলা হয়েছিল, কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জমিতে রাসায়নিক পল্লি তৈরি করা হবে। প্রকল্পে বহুতল ভবন তৈরি করে কারখানা ও গুদাম সরানো হবে এবং প্রকল্পের ব্যয় বহন করবেন ব্যবসায়ীরা।

এ সময় বিসিকের পক্ষ থেকে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের তিনটি সংগঠনকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নানা টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। পাশাপাশি জানায় অন্যান্য শিল্পের মতো কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের প্লট না দিলে তারা কোথাও যাবেন না। ব্যবসায়ীদের আপত্তির ফলে ওই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। ২০১৭ সালের মার্চে আবার নতুন একটি ডিপিপি তৈরি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিসিক, যেখানে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নে রাসায়নিক পল্লি স্থাপনের কথা বলা হয়। ডিপিপি যাচাই-বাছাই করে শিল্প মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।

আরও পড়ুন: চকবাজারে আগুন: জাতিসংঘ মহাসচিবের শোক, সহায়তার আশ্বাস

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। এতে ব্যয় ধরা হয় ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পে মোট ৯৬০টি প্লট করা হবে।

কর্মকর্তারা জানান, সদ্য সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক সচিবদের গাফিলতির কারণে এই প্রকল্প প্রণয়ন করতে এত সময় লেগেছে। ২০১১ সালে প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানাগুলো সরিয়ে মুন্সীগঞ্জ না কি কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হবে, সে সিদ্ধান্তে লেগে গেছে তিন বছর। পরে সব পক্ষের সম্মতিতে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সেখানে একসঙ্গে ৫০ একর জমি কোথায় পাওয়া যাবে, এই প্রশ্নে গেছে আরও চার বছর। যে কারণে ২০১৭ সালে প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু হয়।

এদিকে, প্রকল্পটি যে শিল্প মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখলেই বোঝা যায়। ওয়েবসাইটের প্রকল্পগুলোর তালিকার অনুমোদিত নতুন প্রকল্পের তালিকায় এই প্রকল্পের নাম নেই।

সারাবাংলা/এইচএ/এমএম

চকবাজারে আগুন ব্যবসায়ী মন্ত্রণালয় রাসায়নিক পল্লি

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর