সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বিপজ্জনক আর্মিওয়ার্ম
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৭:২৭
।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: গেল শীত মৌসুমে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে প্রথমবারের মতো ফসলখোকো পোকা ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী এই পোকা আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। বিধ্বংসী এই পোকার হাত থেকে দেশের ফসল রক্ষায় উঠে পড়ে লেগেছেন কৃষিবিদরা।
কৃষি সম্প্রসারণের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সচতেনতা বাড়াতে এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে কর্মশালা। পোকা দমনে দেশের বিজ্ঞানীরা চালিয়ে যাচ্ছেন গবেষণা। এরইমধ্যে পোকা দমনের অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি ফেরোমন ফাঁদ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, আর্মিওয়ার্ম দমনে ফেরোমন ফাঁদই প্রধান পন্থা। ফাঁদে আর্মিওয়ার্ম ধরা পড়ার পর তা মেরে মাটির নিচে এক ফুট গর্ত করে পুতে ফেলতে হবে। আর আক্রান্ত জমিতে বালাইনাশক স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহাইড্রোসিস ভাইরাস (এসএনপিভি) ছিঁটানো (স্প্রে) যেতে পারে। আর ভুট্টায় পোকাটির আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হওয়ায় আক্রান্ত এলাকাগুলোতে আগামী মৌসুমে ভুট্টা চাষ থেকে বিরত থাকারও পরামর্শ কৃষি বিজ্ঞানীদের। এবারের শীত মৌসুমে যেসব অঞ্চলে এই পোকার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে সেখানে ধান চাষের পরামর্শও দিয়েছেন তারা। জমিতে পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা অর্থাৎ পানি থাকলে এই পোকার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসলের মাঠে আর্মিওয়ার্ম পাওয়া গেছে। এর প্রতিষেধক বের করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের গবেষণা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এই পোকার হাত থেকে রক্ষা পেতে আমরা কিছু পরমর্শ দিচ্ছি। করণীয় সম্পর্কে আমাদের একটি প্যাকেজ রয়েছে। আবার এটি প্রতিরোধে দেশে একটি ভাইরাসও (বালাইনাশক) রয়েছে।’
বারির মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘ভুট্টাতে এই পোকাটি ছড়ায় বলে ওই জমিতে ভুট্টা চাষের পরিবর্তে ধান চাষের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সেচ দেওয়া জমিতে এটি ছড়াবে না। একটি দুটি গাছে এই পোকা হলে তা পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে।’
বারি’র পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইংয়ের পরিচালক (পিঅরএল) ড. সৈয়দ নুরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের কয়েকটি জেলায় ভুট্টা ও বাঁধাকপিতে আর্মিওয়ার্ম শনাক্ত হয়েছে। ২২ জেলার ৪০টি উপজেলায় পোকাটি ছড়িয়ে পড়েছে। কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের সব যায়গায় পাওয়া গেছে। শীত মৌসুমে এ জাতীয় পোকার উৎপাদন কম হয়, গরম পড়লে উৎপাদন বাড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রীষ্ম মৌসুমে এটি আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।’
নুরুল আলম বলেন, ‘তবে আর্মিওয়ার্ম নিয়ে মহামারী হওয়ার কারণ নেই। ইতোমধ্যেই উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করা হয়েছে। বাইরে থেকে ফেরোমন ফাঁদ নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। ব্যাপকহারে বালাইনাশক দিয়ে এ পোকা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ফলে ফোরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করেই এটি প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে।’
‘ধানক্ষেত আর্মিওয়াম দ্বারা তেমনভাবে আক্রান্ত হয় না। কারণ এই পোকাটি মাটির নিচে হয়। পানি থাকলে হতে পারে না। তাই ভুট্টাসহ যেসব ফসলি জমিতে আর্মিওয়াম আক্রমণ করেছে, সেখানে পরবর্তীতে ধান চাষের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে’ বলেন নুরুল আলম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নুরুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ফল আর্মিওয়ার্ম তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। এটি নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা সচেতন রয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে ফেরোমন ফাঁদ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর্মিওয়ার্মে প্রতিরোধে এই ফাঁদে ব্যবহৃত সেক্স ফেরোমন আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’
ফল আর্মিওয়ার্ম: ফসলখোকো ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’ সাধারণত কাটুই পোকা নামে পরিচিত। মারাত্মক বিধ্বংসী এই পোকা ২০১৬ সালে আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়ে থাকে, আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ এই পোকা। আমেরিকা মহাদেশের এই পোকা ২০১৮ সালে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া মহাদেশেও। পাশ্ববর্তী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় দেখা দেয় এই পোকার প্রাদুর্ভাব। তবে, শঙ্কার কারণ হয়ে উঠে ২০১৮ সালের নভেম্বরের দিকে দেশে প্রথমবারের মতো ফল আর্মিওয়ার্মের অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া। গেল বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কর্তৃক দেশের উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলের জেলাসমূহে কয়েকটি ফসলে স্থাপনকরা ফেরোমন ফাঁদে প্রথমবারের মত এ পোকার পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়। সম্প্রতি শেরপুর, বগুড়া এবং দামুড়হুদা ও চুয়াডাঙ্গায় ভুট্টা ফসলে এ পোকার আক্রমণ লক্ষ্য করা গেছে।
আক্রমণের পরিধি ও ক্ষতির ধরণ: ফল আর্মিওয়ার্ম ভুট্টা, সরগম, তুলা, বাদাম, তামাক, বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজিসহ প্রায় ৮০টি ফসলে আক্রমণ করে থাকে। তবে ভুট্টায় এ পোকার আক্রমণের হার সর্বাধিক। এই পোকা কীড়া অবস্থায় গাছের পাতা ও ফল খেয়ে থাকে। তবে কীড়ার প্রাথমিক অবস্থায় চাহিদা কম থাকে, শেষ ধাপ সমূহে খাদ্য চাহিদা প্রায় ৫০ গুণ বেড়ে যায়। কীড়া পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগে রাক্ষুসে হয়ে উঠে এই পোকা। এক থেকে দুই রাতেই ধ্বংস করে দেয় কৃষকের সব ফসল।
পোকা চেনার উপায়: পোকাটির দেহের উপরিভাগে দুপাশে লম্বালম্বি ভাবে গাঢ় রংয়ের দাগ থাকে। এর তলপেটের অষ্টমাশের উপরিভাগে চারটি কালো দাগ দেখা যায়। আর মাথায় ‘উল্টা ওয়াই’ অক্ষরের মধ্যে জালের মত দাগ দেখা যাবে।
করণীয়: পোকাটির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কৃষকদের কিছু পরামর্শ দিয়েছে। বারি বলছে, পোকা নিয়ন্ত্রণে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে। ভুট্টা বা অন্যান্য ফসলের জমিতে বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৬টি ফাঁদ পাততে হবে এবং তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ফেরোমন ফাঁদে ফল আর্মিওয়ার্ম এর পূর্ণাঙ্গ পোকা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জমিতে সরাসরি পোকা খাওয়ার লক্ষণ বা এদের মল দেখে আক্রান্ত গাছ শনাক্ত করতে হবে। আক্রান্ত গাছ হতে ডিম বা সদ্য প্রস্ফুটিত দলাবদ্ধ কীড়া চিহ্নিত করে পিষে মেরে ফেলতে হবে বা মাটির নিচে কমপক্ষে একফুট পরিমাণ গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
বারি আরও বলছে, আক্রান্ত গাছ ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল (কমপক্ষে ৩০-৪০ মিটার এলাকা জুড়ে) তাৎক্ষণিকভাবে জৈব বালাইনাশক স্পোডোপটেরা নিউক্লিয়ার পলিহাইড্রোসিস ভাইরাস (এসএনপিভি) (প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম হারে বা ১৫ লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে) ভালভাবে স্প্রে করতে হবে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত গাছসমূহ ভালভাবে ভিজাতে হবে। এভাবে ৭ দিন পর ২ থেকে ৩ বার এসএনপিভি স্প্রে করা প্রয়োজন। এর বাইরে সম্ভব হলে উপকারী পোকা ব্রাকন হেবিটর আক্রান্ত এলাকায় অবমুক্ত করা যেতে পারে (হেক্টর প্রতি ৮০০-১২০০ টি পোকা)। কিন্তু আর্মিওয়ার্ম দমনে রাসায়নিক তেমনভাবে কার্যকর নয়। তবে একান্ত প্রয়োজনে স্পেনোসেড মাত্রনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। আর আক্রান্ত জমিতে অবশ্যই পরবর্তী ফসল হিসাবে ভুট্টা বা এ পোকাটির অন্য পোষক ফসল চাষ না করে ধান চাষ করলে এ পোকার আক্রমণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ফেরোমন ফাঁদ: ফেরোমন ফাঁদ হচ্ছে এক ধরণের কীটপতঙ্গের দমন ফাঁদ যাতে ক্ষতিকর পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ করতে সেক্স ফেরোমন ব্যবহার করা হয়। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকা নিঃসৃত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এমআই