‘মনে হয় জাহান্নামের আগুন দেখেছি’
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৯:৩৪
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: ‘জাহান্নামের আগুন দেখিনি। কিন্তু আমার মনে হয় সেদিন আমি জাহান্নামের আগুন দেখেছি। মানুষ পুড়ে যাইতেছে, আগুন নিয়া মানুষ হাত-পা নাড়তেছে। এই দৃশ্য সেদিন দেখছি আমরা।’ চকবাজারের চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনার বর্ণনা এভাবে দিচ্ছিলেন স্থানীয় ব্যবসায়ী তানভীর আহমেদ তুষার।
রোববার (২৪ ফেব্রুয়ারি) চকবাজারের চুড়িহাট্টায় দেখা হয় সেদিনের ভয়াবহ আগুনের থাবা থেকে বেঁচে যাওয়া তানভীর আহমেদ তুষারের সঙ্গে। ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেই রাতে মানুষ পুড়তেছে। কেউ ছাদের ওপর এই পাশ থেকে ওই পাশে যাইতেছে। দেখতাছি। তাদের সারা শরীরে আগুন। মানুষ তখন চিৎকার করছিল। কিন্তু আওয়াজের কারণে কিছু শোনা যাইতেছিল না।’ তিনি বলেন, ‘বডি স্প্রের যে বোতলগুলো ছিল, সেগুলো ফুটতেছিল। ওয়াহেদ ম্যানশনের চারতলাতে যে মানুষ দৌড়াইতেছিল, সেটা তো সবাই দেখছে। আগুনতো লাগছিল নিচে, যার কারণে সবাই ছাদে উঠে গেছে-মানুষ তো ভাবে নাই, সেই আগুন এমন সর্বনাশা হইবো।’
১৯ বছর বয়সী তানভীর আহমেদ তুষার স্থানীয় মুদি-কনফেকশনারির দোকান মান্নান স্টোরে কাজ করেন গত দেড় মাস ধরে। দোকানটি ছিল আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানসন থেকে ২০/২১ হাত দূরে। প্রতিদিন রাত দশটার দিকে তিনি বাসায় রাতের খাবার যেতে চান। কিন্তু সেদিন তার খাওয়ার কথা মনে ছিল না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দোকানের ম্যানেজার বললেন, ‘ভাই রাত সাড়ে দশটা বাজে। আমার ক্ষুধা লাগছে, খেতে যেতে চাই। ’ ম্যানেজার তাকে বললেন, ‘দুই জন ক্রেতা রয়েছে, তাদের তুমি বিদায় করো। আমি টাকার হিসাব করতেছি।’
ক্রেতাদের বিদায় দিয়ে তুষার জুতার ফিতে বাঁধতে থাকেন। পায়ের দিকে তাকিয়ে ফিতে বাঁধার সময়ই তিনি প্রচণ্ড শুনতে শব্দ পান। চকিতে তাকিয়ে দেখেন আগুন আর আগুন। এ প্রসঙ্গে তুষার বলেন, ‘শব্দটা পাইয়া সামনে তাকাইছি, আর কিছু দেখতেছি না, কেবল আগুন আর আগুন। মৌমাছির ঝাঁকের মতো আগুন। আমি আগুন বলে চিৎকার করে ম্যানেজার মিন্টু ভাইকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম মসজিদের কোণায়। তখন পর্যন্ত আমার জ্ঞান ছিল। চোখের সামনে দেখলাম, একটা মাইক্রো শূন্যের ভেতরে, ৬০ থেকে ৭০ ফিট ওপরে জ্বলতেছে, সেটা জ্যামে আটকে ছিল।’
ওয়াহেদ ম্যানসনে আগুন লাগার ঘটনা কথা যখন তুষার বলছিলেন, তখনো তার কণ্ঠ ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। নিজের প্রাণ বাঁচানোর কৌশল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় ঝাঁপ দেওয়ার পর ভাবলাম, যদি আমি দাঁড়াই, তাইলে পুরো পুড় যামু, মুখ ঝলসে যাইবো। আমি মাটিতে গড়াইতে গড়াইতে ১০ থেকে ১৫ হাত রাস্তার দিকে যাইতে থাকলাম। আমি দেখতেছি কিন্তু হাঁটতে পারছি না, কথা বলতে পারতেছি না। দেখি আমি একটা ড্রেনের ওপরে শুয়ে আছি, অনেকক্ষণ অচেতনের মতো সেখানেই পড়ে ছিলাম।’ তার পা ও বাম হাতে ব্যথার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দোকানের সামনের দিকে শোকেস ছিল। সেই শোকেসের গ্লাস ঢুকে যায় মিন্টু ভাইয়ের পায়ে। তিনি এখন বাসায়।’
মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া চুড়িহাট্টার আগুনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তুষার বলেন, ‘যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন মোবাইলফোনে একটু ভিডিও করলা। তখনো দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। ’
আগুন লাগার পরদিন খালাতো বোনের স্বামী মাকসুদুর রহমানের লাশ নিয়ে কাশীপুর গ্রামেও যান তুষার। জানালেন, বোনজামাই ইসলামবাগে থাকতেন। চাকরি করতেন চকবাজারের হাজী সেলিম টাওয়ারের এক দোকানে। তিনি দোকান থেকে রাতের বেলাতে বাসায় যাচ্ছিলেন, কিন্তু আগুনের কবলে পড়ে রাস্তায়ই তার মৃত্যু হয়।’ পরদিন বাড়ি থেকে জানানো হয়, বোন জামাইকে পাওয়া যাচ্ছে না, পরে ঢাকা মেডিকেলসহ সব হাসপাতালে তার খোঁজ নেওয়া হয়। পরে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।’
আগুনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তুষার বলেন, ‘সেদিন অনেক জ্যাম ছিল, তিনদিন সাপ্তাহিক ছুটি। এই পুরো রাস্তাটা গাড়ি আর রিকশায় আটকানো ছিল। আমাদের দোকানেও অনেক পরিচিত লোক জামা-কাপড় রেখে গেছিল, বলছিল ১২ টায় লঞ্চ। যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন।’
ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তুষার বলেন, ‘সে রাতের পর থেকে ঘুমাইতে পারি না। দুই দিন তো একেবারেই খাইতে পারি নাই, এখনো সমস্যা হচ্ছে। প্রথম দুই দিন ঘুমানোর পরই দুপদাপ সেই বোতল ফোটার শব্দ পাইতাম। চোখের সামনে আগুন দেখতাম। কত ঘুমাইতে চেষ্টা করতাছি, কিন্তু ঘুম আসতেছে না আমার।’
উল্লেখ্য, বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন আশপাশের ভবনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটে।
সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ