Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কর দেওয়ার পরিবেশ সহজ করে দিতে হবে: সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান


২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২১:১১

২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। পরে দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও। দেশের বর্তমান রাজস্ব পরিস্থিতি ও অর্থনীতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন সারাবাংলার বিশেষ আয়োজন ‘বিজনেস এক্সপ্রেস’-এ। তারই কিছু অংশ তুলে ধরা হলো সারাবাংলার পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার জয়েন্ট নিউজ এডিটর জিমি আমির

সারাবাংলা: আপনি নিজে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আপনার পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন?

বিজ্ঞাপন

আব্দুল মজিদ: আমি মনে করি, রাজস্ব বোর্ড অগ্রগতির পথেই আছে। তবে চ্যালেঞ্জগুলো সময়ে সময়ে পরিবর্তন হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এনবিআরের যে সক্ষমতা বা দক্ষতা, সেটারও সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়েছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সামনে আছে। একদিকে তাকে বড় টার্গেট দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনীতির আকার বিবেচনায় এই টার্গেট পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনুযায়ী যে ধরনের রাজস্ব আহরিত হওয়ার কথা, সেখানে একটি ফাঁক থেকে যাচ্ছে। এ কারণে ট্যাক্স জিডিপি রেশিওর দূরত্ব বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: আপনার সময়ের তুলনায় এখন এনবিআরের সক্ষমতা কোন কোন জায়গায় বেড়েছে?

আব্দুল মজিদ: আমাদের সময়ে লোকবল ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে সম্প্রসারিত করার যে ঘোষণা ছিল, তা বাস্তবায়ন হয়েছে ২০১৩ সালে। তবুও পুরোপুরি বাস্তবায়নে এখনও ধীরগতি লক্ষ্যণীয়। অনেকগুলো করের অফিস হয়েছে, অনেকগুলো সার্কেল বেড়েছে। সব নতুন জেলাকে এনবিআরের আওতায় আনা গেছে। এসব ডেভেলপমেন্টের পরও রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনাকে তেমন গতিশীল করা যায়নি। এটার প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু আমার এই চেষ্টাকে ধীরগতি বলে মনে হচ্ছে। দক্ষ জনবল বাড়িয়ে তদারকির মধ্যে যে কাজ করার কথা, তাতে মনে হচ্ছে এনবিআর সংগ্রাম করছে।

সারাবাংলা: গত ১০ বছর ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। এতে কি রাজস্ব আদায়ে উন্নতি হয়েছে?

আব্দুল মজিদ: অবশ্যই উন্নতি হয়েছে। সেটা তো ফিগার দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী গুণগত মান বাড়েনি। আমি মনে করি, আহরণ করার ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি উদ্ভাবন হওয়া দরকার। অর্থাৎ করদাতার পেছনে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে হবে কেন? এখানে যদি অনলাইন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, তাহলে উভয়ের জন্যই লাভজনক হয়। করদাতারা দায়িত্ব মনে করে কর দেবেন, কর্মকর্তারা সেটি দেখভাল করবেন। করদাতাদের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য রীতিনীতি, পদ্ধতি বা আইনের যে সংস্কার দরকার, সেসব সমানতালে সব জায়গায় এসে মেশেনি। যেমন— ২০১২ সালের ভ্যাট আইন এখনও বাস্তবায়নের পর্যায়ে যায়নি। এসব কাজে এনবিআরের কার্যক্রমকে ধীরগতির মনে হয়।

সারাবাংলা: অনেক করদাতাকে করের আওতায় আনা যায়নি। এগুলো কি এনবিআর কর্মকর্তাদের গাফিলতি না অদক্ষতা?

আব্দুল মজিদ: কর্মকর্তারা অদক্ষ— এটাও যেমন ঠিক, অন্যদিকে তাদের লোকবল সংকটের বিষয়টিও দেখতে হবে। তাছাড়া, কর দেওয়া ও আহরণে দুই পক্ষ থেকেই সহযোগিতা থাকতে হবে। করদাতাকেও সহযোগিতা করতে হবে। ইদানীং করদাতাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসার জন্য মেলা অনেক বড় ভূমিকা রাখছে। করমেলার মাধ্যম একধরনের সচেতনতা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মেলায় নিজেই আগ্রহ করে এসে ট্যাক্স জমা দেয়। তাই করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা ও কর দেওয়ার কাজ সহজ করার পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব রাজস্ব বোর্ডেরই।

সারাবাংলা: ভ্যাটের একটি হার নির্ধারণ করা নিয়ে গত দুই-তিন বছর ধরে ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে নানা ধরনের দরকষাকষি চলছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?

আব্দুল মজিদ: দেশের অর্থনীতি অনুযায়ী, একাধিক ভ্যাটের হার থাকবে। থাকতে হবে, থাকা উচিত। কিন্তু ২০১২ সালে আইন পাস করে বলা হলো— না, একটাই রেট হবে। আমার অর্থনীতি এখনও একহারের অবস্থায় যায়নি। ব্যবসায়ীরাও এটা নিয়ে আপত্তি করছে। ভ্যাটের হার একাধিক না একটি থাকবে, এ বিষয়টিকে তুলে আইনটিকে দেরিতে প্রবর্তন করা যৌক্তিক নয়। এজন্য অনেক ধরনের অর্থবিধি আছে। এসবের মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান করা যায়।

সারাবাংলা: ২০১২ সালের ভ্যাট আইনে আসলে কী আছে?

আব্দুল মজিদ: সবাইকে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। কিভাবে ভ্যাটের হিসাব হবে, তার পদ্ধতি ঠিক করার কথা বলা হয়েছে। দেশের প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ মানুষই প্রান্তিক। এসব মানুষের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলে অনেক চাপ বাড়বে। তবে এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইন প্রবর্তন করা দীর্ঘসূত্রিতার বিষয় হওয়া উচিত নয়। নানা ধরনের অর্থবিধি আছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই হয়। একাধিক হার থাকতে হবে। ভারতেও চারটি হার আছে। বরং ভ্যাট দেওয়া সহজ করতে সবাইকে এনবিআর আর ভ্যাট দাতাদের অটোমেশনের আওতায় আনা উচিত। অথচ একটি হার নিয়ে যেভাবে আলোচনা হচ্ছে, এটাকে দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

সারাবাংলা: আমরা লক্ষ্য করছি, ভ্যাট থেকে সরকারের আয় বাড়ছে। এটি কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর চাপও তৈরি করছে। অথচ এক সময় আয়কর থেকে সরকারের রাজস্ব বেশি আসত। ভ্যাটের পাশাপাশি আয়কর থেকে আয় বাড়ানোর দিকেও কি সরকার নজর দিতে পারে না? আপনি কী মনে করেন?

আব্দুল মজিদ: প্রত্যক্ষ কর হিসেবে ভ্যাট সবাই দিচ্ছেন। কিন্তু যার আয় ট্যাক্সযোগ্য, তিনিই শুধু আয়কর দিচ্ছেন, যেটি পরোক্ষ কর। চাইলেই আয়কর থেকে ট্যাক্স বাড়ানো যায় না। তাই ভ্যাটের দিকেই মনোযোগী হতে হবে। মানুষ ভ্যাট দিচ্ছে, মধ্যবর্তী উপায়ে তা আদায়ও হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে তা জমা হচ্ছে না। এখানেই সমস্যা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ভ্যাট বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না। বরং আরও দুই-তিন গুণ বাড়ানো দরকার ছিল। ২০১৭ সালে এনবিআর জানালো, ভ্যাট আইন প্রবর্তন করলে ২০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট বাড়বে। কিন্তু পরে যখন আইনটি বাস্তবায়ন হলো না, তখন ২০ হাজার কোটি টাকাও আর এলো না। অথচ ভ্যাট কিন্তু ঠিকই কাটা হচ্ছে। তাই বারবার একটি কথাই বলতে চাই— ভ্যাটদাতা নয়, সব ভ্যাট আহরণকারীকে অটোমেশনের আওতায় আনতে পারলেই রাজস্ব আহরণ অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

সারাবাংলা: রাজস্ব আহরণে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

আব্দুল মজিদ: টার্গেট পূরণে রাজস্ব আদায় রাজস্ব বোর্ডের একমাত্র কাজ না। অর্থনীতিতে বৈষম্য কমানো বা রি-ডিস্ট্রিবিউশন অব ওয়েলথ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অন্যরকম উদ্দেশ্য। যে খুব ধনী হচ্ছে, তার কাছ থেকে কর নিচ্ছি না। আর মধ্যবিত্ত একজনের ওপর সব চাপ দেওয়া হচ্ছে। তাই প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সবাইকে কর দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাট, ট্যাক্স আরোপের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব যেন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা। সব জায়গায় কর সমানভাবে আরোপ হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। এতে অর্থনীতি প্রবাহমান থাকবে এবং ভ্যাট বা ট্যাক্স ঠিকমতো আসবে। বৈষম্য কমে আসবে। আর একটা দিক হচ্ছে, অর্থনীতি থেকে আহরণ করতে চাচ্ছি, তা কেমন অবস্থায় আছে তাও দেখতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টর থেকে অনেক বেশি রাজস্ব আসে। এখন এই ব্যাংকিং খাত যদি অসুস্থ হয়, তাহলে রাজস্ব আসবে কোথা থেকে? এসব বিষয় দেখতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। তাহলে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি এমনিই বেড়ে যাবে।

সারাবাংলা/জেএএম/টিআর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

২৪ বলে ০ রানে জাকিরের লজ্জার রেকর্ড
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:১৮

সম্পর্কিত খবর