Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘পোড়া দোকানডা সবাই দেখে, পোড়া মনডা কারে দেখাই?’


২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৫:২২

ক্র্যাচে ভর দিয়ে পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আব্দুল মান্নান

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে পাঁচটি সড়কের সংযোগস্থল। এই সংযোগস্থল লাগোয়া ছিল মান্নান স্টোর, মুদি-কনফেকশনারি দোকান। সে দোকানের মালিক আব্দুল মান্নান। তিনি গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন। এরপর যান দোকান দেখতে। দেখেন সেখানে কেবল জিনিসপত্রের ছাই পড়ে আছে। এই প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সবাই পোড়া দোকানডা দেখতেছে, কিন্তু আমার পোড়া মনডা কারে দেখাই? কারে দেখাই সেখানে থাকা অঙ্গার?’

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে গিয়ে দেখা হয় ৪৯ বছরের আব্দুল মান্নানের সঙ্গে, কথাও হয়। জানালেন, ১২  লাখ টাকা পুঁজি দিয়ে ১৬ বছর ধরে এই মান্নান স্টোর গড়ে তুলেছেন তিনি। এ ঘটনার দশদিন আগে থেকে আব্দুল মান্নান কোমরের হাড়ক্ষয় নিয়ে ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। তাকে চিকিৎসকরা আরও থাকতে বলেছিলেন। তিনি থাকননি। চিকিৎসকসহ পরিবারের সবাইকে বলেছিলেন, ‘কতদিন দোকানে বসি না, দোকানে বসলে আমি ঠিক হয়ে যাবো।’

বিজ্ঞাপন

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সেদিন দোকানে আমার দু’টা ছেলে (কর্মচারী) ছিল। আল্লাহ তাদের বাঁচাইয়ে দিছে। দেশের বাড়ি নোয়াখালী। ’ এই এলাকায় তার দোকানটিই ছিল বড় বলেও দাবি তাদের। বাসা চাঁদনিঘাটে তার বাসা। সেদিন কখন শুনলেন আগুনের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার পরপরই বাসায় বসে খবর পাই, তারপরই অজ্ঞান হয়ে যাই।’

দোকানের নামফলক খুঁজছেন আব্দুল মান্নান

অনেকেই এখন অনেক রকম সুযোগ নিতে চাইবে মন্তব্য করে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সবসময়ই সুযোগসন্ধানীরা আশেপাশে থাকে। দেখা যাবে, তারা নিজেদের অনেক ক্ষতির কথা বলবে, কিন্তু আমরা যারা আসলেই ক্ষতিগ্রস্ত, তারা কিছু বলতে পারবো না। সমস্যার সমাধান হবে আমাদের সঙ্গে কথা বললে।’

আরও পড়ুন: চুড়িহাট্টায় আগুন, সিটি করপোরেশন কী করে প্রশ্ন আদালতের

গণমাধ্যমের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আপনারা একটু মন্ত্রীদের বা যারাই এ কাজে তদন্ত করতে আসছে। তাদের বলেন, আমাদের সঙ্গে যেন একটু কথা বলেন। আমরা যেন তাদের সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগ পাই।’

আব্দুল মান্নানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশেই এসে দাঁড়ান মোহাম্মদ মহসীন। ওয়াহেদ ম্যানশনের ঠিক উল্টো দিকেই তার টুপি-জায়নামাজের গোডাউন। তিনি বলেন, ‘সব পুড়ে গেছে। কিছু বাকি নেই।’

মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘চকবাজারে দোকান। নাম মাহবুব ক্যাপ হাউস। কিন্তু এখানে মূল গোডাউন ছিল। দুই বছর ধরে এই গোডাউন। ‘ আটটার দিকে সেদিন দোকান বন্ধ করে তিনি বাসায় চলে যান, আগুন লাগার খবর পেয়ে ১১টার দিকে এখানে আসেন। কিন্তু ঢুকতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘সকাল বেলায় এলাম। এসে দেখি, সব শেষ। কিছুই নেই। ‘

সামনে রোজার মাস। রোজার মাস উপলক্ষে প্রায় ৯০ লাখ টাকার জায়নামাজ, টুপি আর তসবিহ এনে গোডাউনে রেখেছিলেন বিক্রির জন্য। তিনি বলেন, ‘গোডাউনে রাখার জন্য বিভিন্ন কোম্পানি থেকে মালামাল নিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনের থেকে ধার করে মালামাল তুলেছি গোডাউনে-দোকানে।’

লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ মহসীনও আব্দুল মান্নানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘মন্ত্রী সাহেবরা আসছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে দলীয় মানুষ অনেক বেশি থাকে। তাদের সঙ্গে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয় না ভিড়ের জন্য। কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা যদি সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ না পান, তাহলে কী করে চলবে? সরাসরি কথা বললে তারা হয়তো আমাদের কথা বুঝতেন, দুঃখ বুঝতেন।’

পোড়া দোকান

পুড়ে যাওয়া মান্নান স্টোর

‘যার যায়, সেই কেবল বোঝে’ মন্তব্য করে মোহাম্মদ মহসীন বলেন, পুরো দেশ আমাদের জন্য সমব্যথী। কিন্তু আমার কথা তো অন্য কেউ বলতে পারবে না। আমার ক্ষতটা অন্য কেউ বুঝবে না। আমার ব্যথাটা কেবল আমিই বলতে পারবো। আমিই বোঝাতে পারবো।’ তিনি বলেন, সবসময়ই এ ধরনের বড় দুর্যোগে সুবিধাভোগীরা চারপাশে ঘোরে। কিন্তু আমি চাই না, আমার নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ সুবিধা নিক। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা পাবে না কিছু, কিন্তু সুবিধাভোগীদের জন্য নাম হবে। সবাই পেয়েছে।’

আরও পড়ুন: ‘মনে হয় জাহান্নামের আগুন দেখেছি’

গোডাউন তো পুড়ে গেলো, এখন কী করবেন জানতে চাইলে মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘কী আর করবো, কষ্ট করে চলতে হবে। আমরা তো আর কিছু জানিও না সেটা করে পেট চালাবো।’

আর আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে সেটা পূরণ হওয়ার নয়, বলছিলেন মফিজুল ইসলাম। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের মফিজুল ইসলামের দোকান ছিল মোহাম্মদ মহসীনের গোডাউনের পাশেই। প্লাস্টিকের গুঁড়োর দোকান ছিল তার। তিনি বলেন, ‘সাড়ে নয়টায় দোকান বন্ধ করে গিয়েছি। বাসায় গিয়ে শুনি আগুন লেগেছে। দৌড়ে আবার এলাম। কিন্তু দোকানের কাছে আর আসতে পারিনি। সকালে এসে দেখি কিছুই নেই। একটা দানাও নেই।’

উল্লেখ্য, বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন আশপাশের ভবনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ

চকবাজারে আগুন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর