Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেয়ে গেলো ক্যানসারে, ছেলে আগুনে


১ মার্চ ২০১৯ ১৬:০২

ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ (ফাইল ছবি)

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: ‘আমার বড় মেয়েকে কেড়ে নিলো ক্যানসার, একমাত্র ছেলেটা মারা গেলো আগুনে পুড়ে। ক্যানসার আর আগুন মিলে আমার পূর্ণ সংসারটাকে শূন্য করে দিয়ে গেলো। এ বিশাল ঘরে আমি আর ওদের বাবা কী করে থাকবো?’ এমন প্রশ্ন রেখেই কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলফোনে ছেলের ছবি দেখতে থাকতেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা মর্জিনা আক্তার।

বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা মর্জিনা আক্তারের সঙ্গে। চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনে আগুনের ঘটনায় পুড়ে মারা যান মর্জিনা আক্তারের একমাত্র ছেলে ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ। ওয়াহিদ ম্যানশনের ঠিক উল্টো দিকের গলির ভেতরেই তাদের বাসা।

বিজ্ঞাপন


মাহিদের মৃত্যুতে স্থানীয়দের শোক প্রকাশ

বিশাল বাসায় আত্মীয়-স্বজনের ভিড়। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর সংবাদে স্বজনদের অনেকেই এসেছেন। এরই মাঝে মাহিদের মা-বাবা কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। জানালেন, তাদের তিন সন্তান। এরমধ্যে ২০১১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের বড় মেয়ে নূর-এ আজরীন। আর ২০ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) দিবাগত রাতে আগুনে পুড়ে মারা যান একমাত্র ছেলে ওয়াসি উদ্দিন মাহিদ।

সেদিন সারাদিনই মাহিদ বাসায় ছিল বলে জানালেন মা মর্জিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘সেই রাতে মাহিদ বাসার বাইরে যাওয়ার আগে বললাম, একটা মালটা কেটে দেই? খেয়ে যা। ছেলেটা সহজে কিছু খেতে চাইতো না। কিছু বললেই বলতো, এত এত খাওয়া করো কেন? কিন্তু সেদিন বললো, দাও। ছেলের দাও শুনে আমি একটা না, ঘরে থাকা দুইটা মালটাই কেটে দিলাম। আমার ছেলেটা বসে বসে সবটুকু খেলো। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু বুঝিনি, এটাই আমার শেষ খাওয়ানো। আমি আর কোনোদিনই ছেলেকে সামনে বসিয়ে খাওয়াতে পারবো না!’

বিজ্ঞাপন

মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘রাত সোয়া দশটার দিকে ছেলেটা ঘর থেকে বের হলো। গলির মুখে পৌঁছাতে পেরেছে কী পারেনি, তখনই বিকট আওয়াজ শুনলাম। প্রথমে ভেবেছি, মেঘ করেছে, বাতাস হচ্ছে। হয়তো কোনো ছাদ থেকে কিছু নিচে পড়েছে। কিন্তু তখনই বাসায় বলছিলাম, আমার ছেলেটা মাত্র গেলো। আল্লাহ জানে, ওর মাথায় কিছু পড়লো কি না। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ফোন করলাম, ফোনটা বেজে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা ফোন ধরছে না। বারান্দায় গেলাম। দেখলাম, পুরো এলাকা, লাল আগুনের লাল হল্লা, সে কী লাল!’

আরও পড়ুন:  ‘মনে হয় জাহান্নামের আগুন দেখেছি’

ওয়াহেদ ম্যানসনে আগুনে নিজের ছেলেকে হারানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝরে কাঁদছিলেন এই মা। বললেন, ‘আর পারলাম না, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম খালি পায়ে। হাতে মোবাইল নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। আমি সামনে যেতে চাইলে একটা ছেলে বলে, আপনি পাগল হয়েছেন? আগুন লেগেছে ওখানে। তাকে বললাম, আমার ছেলে আছে ওইখানে। তারপর সবার সঙ্গে পেছনের গেট দিয়ে বের হলাম। কোথায় যাচ্ছি, নিজেও জানি না। একসময় দেখলাম উর্দু রোডের ঢাল। ওখানে গিয়ে মেজ মেয়ে আনহাকে ফোন দিলাম।’

মাহিদের মা মর্জিনা আক্তার

মর্জিনা বলেন, ‘খবর পেয়ে মেজ মেয়ে ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড হাসপাতাল সব জায়গায় খুঁজলো। কোথাও পেলো না। আমি সারারাত রাস্তায় বসে রইলাম ছেলের অপেক্ষায়। এই বুঝি আমার ছেলে আসবে। কিন্তু ছেলে আর এলো না। সকালে শুনলাম, ছেলে আমার মারা গেছে।’

ছেলেকে আজিমপুর কবরস্থানে রেখে এসেছেন উল্লেখ করে মর্জিনা বলেন, ‘ছেলেকে কবরে রাখার সময় বলে এসেছি, বেশিদিন থাকতে হবে না একা একা। আমিও আসবো। ছেলেটা যে ঘরে ‍ঢুকেই আম্মু আম্মু বলে চিৎকার করতো, একা থাকতে পারতো না। ওখানেও ও তাই করছে। আমি কী করে ওকে একা রাখি বলেন?’

ছেলের কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে যান মর্জিনা আক্তার। বেডরুমে থাকা শোকেসের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ওই যে ভেতরে ছবিটা, ওটা আমার মাহির ছোটবেলার ছবি। আমার ঘরজুড়ে ওর ছায়া, ওর স্মৃতি। এ ঘরে আমি কেমন করে থাকি?’

আরও পড়ুন: আগুন, সাংবাদিকতা ও কিছু উপলব্ধি

মর্জিনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘরে ঢোকেন মাহিদের বাবা নাসিরুদ্দিন। জানালেন, তার সঙ্গে ব্যবসার হাল ধরেছিল মাহিদ। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে বড় মেয়ে নূরে আজরীন ক্যানসারে মারা গেলো। আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তো। উদয়ন স্কুল আর ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পাস করে ।’

এই বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,  কিন্তু সে মেয়েটা মারা গেলো ব্ল্যাড ক্যানসারে। একেবারেই শেষ ধাপে গিয়ে সেটা ধরা পড়ে। তারপরও চেষ্টা করেছি। ভারতে আর ঢাকায়, কোথায় না চেষ্টা করেছি? কিন্তু আমার মেধাবী মেয়েটা চলে গেলো!’

স্বামীর কথা শেষ হতে না হতেই মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘খুব ভালো ছিল আমার এই মেয়েটা। বড় মেয়েটা মারা গেছে ২২ বছর বয়সে ১৬ ডিসেম্বরে। ছেলেটাও মারা গেলো সেই ২২ বছর বয়সে ২১ ফেব্রুয়ারিতে। এ কেমন নিয়তি আমার, জানি না।’

মাহিদের বাবা নাসিরুদ্দিন

বাবা নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘ওয়াহিদ ম্যানশনের পাশেই জামাল সরদার কমিউনিটি সেন্টার মাত্র পার হচ্ছিলাম আমি। ওই সময় শুনলাম বিকট শব্দ। আমার ছেলেটা হয়তো আমার থেকে তখন কয়েক হাত দূরে ছিল। ঠিক ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনেই। আগুন ছেলেটাকে নিয়ে গেলো!’

নাসিরুদ্দিন আরও বলেন, ‘আমার এই ছেলেটাই আমার হাতের লাঠি ছিল। কিন্তু সেই ছেলেটাই চলে গেলো। নিয়ম অনুযায়ী আমার এখন চলে যাওয়ার কথা। আমার ছেলে আমাকে কাঁধে নেবে, মাটিতে শোওয়াবে। কিন্তু বিধি কী নির্মম খেলাটাই না খেললো আমার সঙ্গে! পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝাটা আমাকে কাঁধে নিতে হলো!’

উল্লেখ্য, গত বুধবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন আশপাশের ভবনগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

সারাবাংলা/জেএ/এমএনএইচ

ক্যানসার চকবাজারে আগুন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর