একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু: কারণ নিপাহ ভাইরাস!
৩ মার্চ ২০১৯ ২৩:০২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঠাকুরগাঁওয়ে একই পরিবারের পাঁচ সদস্যের মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিপাহ ভাইরাসকে চিহ্নিত করেছেন জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষক দল। রোগের অনুসন্ধান করে তারা জানায়, মৃত ব্যক্তিদের সবার জ্বর, মাথা ব্যাথা, বমি ও মস্তিষ্কে ইনফেকশনের (এনসেফালাইটিস) উপসর্গ ছিল। তাদের একজনের নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় এবং সে নমুনায় নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
রোববার (৩ মার্চ) রাতে আইইডিসিআরের জেষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে এসব তথ্য জানান। তবে যারা এখনও জীবিত রয়েছেন, তাদের রক্তে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
ডা. আলমগীর জানান, আইইডিসিআর বিভিন্ন সময়ে মৃত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি এবং তাদের স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছে।
আরও পড়ুন- অজ্ঞাত রোগ নির্ণয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে গবেষক দল, মাস্ক পরার পরামর্শ
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত ফলভোজী সংক্রমিত বাদুড়ের লালা থেকে নিপাহ ভাইরাস প্রবেশ করে খেজুরের রসে। কাঁচা বা অপরিশোধিত অবস্থায় সেই রস খেলে সেই ভাইরাসের জীবাণু প্রবেশ করে মানব শরীরে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও এ রোগ ছড়াতে পারে।
আইইডিসিআর বলছে, ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনায় প্রথম মৃত ব্যক্তির খেজুরের কাঁচা রস পান করার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস না পাওয়া গেলেও অন্যান্য মৃত ব্যক্তিরা প্রথম মৃত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ ফেব্রুয়ারি অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর ধনতলা ইউনিয়নের নয়াবাড়ি গ্রামের তাহের আলী ও তার স্ত্রী দুই দিনের ব্যবধানে মারা যান। এর কয়েকদিন পর মারা যান তাদের মেয়ে জামাই হাবিবুর। রোববার সকালে তাহের বড় ছেলে ইউসুফের মৃত্যু হয়। ওই দিনই ছোট ছেলে মেহেদী হাসানকে (২৫) মুমূর্ষ অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই দিন রাত সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
একই পরিবারের এই পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ঠাকুরগাঁও স্বাস্থ্য বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়। এরপর এ ঘটনার রোগের কারণ অনুসন্ধানে আইইডিসিআর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশন টিম পাঠায় ঘটনাস্থলে। পরে আরও চার সদস্য যোগ দেন তাদের সঙ্গে।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত তদন্ত দলটি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তদন্ত করেন। সেই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতেই আইইডিসিআরের জেষ্ঠ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আলমগীর জানালেন, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই মৃত্যু হয় ওই পাঁচ জনের।
এ পরিস্থতিতে আইইডিসিআর খেজুরের কাঁচা বা অপরিশোধিত রস পান থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের নিপাহ সংক্রমণ প্রতিরোধে মাস্ক ও গ্লাভস পরিধানের নির্দেশনাও দিয়েছে। যারা সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবা দেবেন, তাদের জন্যও একই নির্দেশনা প্রযোজন্য হবে। আইইডিসিআর জানিয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর হাত সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এ রকম রোগের ক্ষেত্রে রোগীদের সম্পূর্ণ পৃথক স্থানে রাখা ও পৃথক স্থানে সেবা প্রদানের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হলে তার লালা, রক্ত, মল ও মূত্রের সংস্পর্শে যেন কেউ না আসেন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। একইসঙ্গে মাস্ক ও গ্লাভস পরে নির্দেশিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃতদেহ গোসল করাতে হবে। যারা গোসল করাবেন, তারা মৃতদেহ গোসল করানোর পরে নিজেরাও সাবান দিয়ে গোসল করবেন এবং ধোয়া কাপড় পরবেন।
উল্লেখ্য, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘নিপাহ রোগ বিস্তাররোধে গণসচেতনতা: গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভা আয়োজন করে আইইডিসিআর। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সেখানে জানান, সারাদেশে ১৯ বছরে নিপাহ ভাইরাসে মারা গেছেন ২১১ জন। এছাড়া, এ পর্যন্ত ৩০৩ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি বছরেও দুইজন আক্রান্ত হন।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর